শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১০

১৯৭১ : যা কিছু আমার; আমার প্রথমসকল


জীবনে সর্বপ্রথম যে গানটি শুনেছিলাম

আপনাদের কি মনে পড়ে জীবনে সর্বপ্রথম কোন্‌ গানটি শুনেছিলেন?

এর আগে আমি অন্য কোনো গান হয়তো শুনে থাকবো, কিন্তু তার কিচ্ছুটুকুন আমার মনে নেই। বা গান বলে যে একটা বস্তু বা বিষয় আছে তাও হয়তো এর আগে বুঝি নি।

তবে এ গানটি গান হিসেবেই কবে কোথায় কিভাবে শুনেছিলাম তা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

১৯৭১।
বর্ষার প্রথম পানিতে গাঁয়ের খাল ভরে গেছে। আমি বাবার সাথে চকে গেছি ধানক্ষেত দেখতে। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। কিছু আগে সামান্য বৃষ্টি হয়ে গেছে, আকাশে ঝলমলে রোদ্দুর আর ক্ষেতের উপর বাতাসের ঢেউ সমেত গরমের হলকা।

বাবার সাথে গুটি গুটি পায়ে খালের পার ধরে বাড়ি ফিরছি। পারাপারের জায়গাটাতে এসে আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়াই। এখানে ডাকের খেয়া নেই, পানিতে নেবে বা সাঁকোতে খাল পার হতে হয়। ওখানে সাঁকো ছিল না।

মামা সম্পর্কের একজন ভাটি থেকে উজান টেনে নৌকা বেয়ে আসছিলেন। তাঁকে দেখেই বাবা ডাকলেন, ও ইয়ার আলী, পার কইরা দেও।

ইয়ার আলী মামা নৌকা ভিড়ালেন। বাবা আমাকে সাবধানে উঠিয়ে মাঝখানে বসালেন। ছোটখাটো দু-একটা কথা। তারপরই নৌকা বাইতে বাইতে ইয়ার আলী মামা গেয়ে উঠলেন :

আমার সোনার বাংলা.........

আমার কাছে খুব ভালো লাগলো। এমন গান আগে শুনি নি। যা শুনেছি তা হলো বৃষ্টি নামানোর ছড়া, যা মেয়েরা বুনো ফুল আর চালুনি মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘটীর পানিতে ভিজতো আর বৃষ্টির জন্য গাইতো।

কিন্তু.......আমার সোনার বাংলা.........এ তো এক আশ্চর্য গান! আমি মনে মনে চেষ্টা করি, অল্প অল্প পারি।

বাড়ি গিয়ে মাকে বলি, ইয়ার আলী মামু গান গাইবার পারে..........এ কথা দ্বারা কী বোঝাতে চেয়েছিলাম তা মনে নেই, কিন্তু আমি ঠিক এরকম একটা কথাই মাকে বলেছিলাম........ইয়ার আলী মামু সোনার বাংলা গান গাইছে।

এরপর সপ্তাহখানেকের মধ্যে আমি আরো একজনকে এ গানটা গাইতে শুনেছিলাম। তারপর আমি অনেকের মুখেই এ গানটা শুনতে পেয়েছিলাম। যেই এ গানটা গাইতো, আমি দৌড়ে তার কাছে গিয়ে, পিছে পিছে হাঁটতে হাঁটতে এ গানটা শুনতাম।

ভয়াল ২৫ মার্চের উত্তাপ তো এর কতো আগেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি কি অতোসব তখন বুঝি? যা বুঝি তা এখানে লিখে রেখেছি ; তবে লেখাটি ১৯৯৯-এ নয়, ১৯৯৩-এ লিখেছিলাম।

'আমার সোনার বাংলা' আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, এ তো জেনেছি অনেক পরে যখন বোঝার জ্ঞান হয়েছে। কিন্তু এ গানটার মধ্য দিয়েই আমার গান শোনার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা ভাবতে গেলে খুব পুলকিত, বিস্মিত ও কেবল গর্বিত হতে থাকি আর আনমনে গেয়ে উঠি :

আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি.........


যেদিন প্রথম পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলাম

ব্যাপারটা ভেবে আপনিও বিস্মিত হবেন- কখনো কি জাতীয় পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন? অনেকের এরূপ অভিজ্ঞতা থাকলেও আমাদের কিন্তু খুব কমই সুযোগ আসে জাতীয় পতাকা হাতে তুলে নেবার।

কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনেক অনেক আগে আমি একটা পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলাম। সেই মামুলি কাহিনীটা বলি।

সেদিন দুপুরে এক মিছিল এলো। ছেলেবুড়ো, যুবক সবাই সেই মিছিলে। তাদের কণ্ঠে উদাত্ত শ্লোগান। তাদের কারো কারো হাতে পতাকা। দৌঁড়ে যাচ্ছে মিছিল- দৌড়ে যাচ্ছে।

মিছিল গিয়ে জমায়েত হলো স্কুলের ময়দানে। চারদিক থেকে ছুটে আসতে লাগলো মানুষের ঢল। বিরাট মাঠ মানুষে ভরে গেলো। মাইকে অনবরত বেজে চলছে আমার সোনার বাংলা গানটি।

১৯৭১-এ আমার বয়স কতো ছিল জানি না। আর যেদিনটার কথা বললাম তখন বুঝি নি, শুধু জ্ঞান হবার পরই সুনিশ্চিত ধারণায় বুঝেছিলাম ওটা ছিল ১৬ই ডিসেম্বর। যখন গাঁয়ের রাস্তা জনস্রোত আর গগনবিদারী স্লোগানে টলোমল করছিল, হাতে ছিল পতাকা- কি মহোল্লাসে আমারও চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছিল- কি অভূতপূর্ব উত্তেজনা, এক দুর্দমনীয় নেশা হাতে একটা পতাকা ধরার জন্য। কিন্তু ন্যাংটো শ্রীযূতকে কে দেবে পতাকা?

আমার মতো আরো অনেকের হাতেও এমন পতাকা ছিল- তাই আর মুহূর্ত দেরি নয়, হাতের নাগালেই ছিল খড় নাড়ার কাড়াল, আর ছিল আমার প্রিয় মলিন গামছাটি। আমি কাড়ালের মাথায় গামছা বেঁধে এক পলকে বানিয়ে ফেললাম বাংলাদেশের পতাকা- আর দৌড়ে মিশে গেলাম রাস্তার মিছিলে।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এভাবেই আমার হাতে প্রথম এসেছিল।


স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিন

আমার সব 'প্রথমে'র রেফারেন্স পয়েন্ট হলো ১৯৭১। তখন বয়স কতো ছিল জানার উপায় নেই, কারণ কৃষকের ছেলের জন্মতারিখ লিখিত থাকে না, ধাইমার হাতে সে ভূমিষ্ঠ হয়; মা-চাচি-দাদি-নানিরা ঘোর বৃষ্টির দিনে, তুমুল তুফানের রাতে বাংলা মাসের 'অমুক তারিখে' বা 'অততম' চাঁদের দিন জন্ম হয়েছিল- এভাবে দিনতারিখ মনে রাখেন। তারপর নবম শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশনের সময় গড়পড়তা একটা জন্মতারিখ, যা চাকরিক্ষেত্রে সুবিধা দিতে পারবে অনুমান করে লিখা হয়ে থাকে, যাতে প্রায়শ প্রকৃত জন্মতারিখ থেকে বিস্তর ব্যবধান থাকে।

আমি বড্ড নিরীহ প্রাণী সেই ছোটকাল থেকে- কেবল ঘরের বাইরে; এজন্য কতো পিটুনি খেয়েছি পরের হাতে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ঘরের ভেতর আমার দুরন্তপনায় সবাই সবসময় ভীষণ অতিষ্ঠ থাকতো; বাইরে পরের হাতে মার, ঘরের ভেতর মায়ের পিটুনি খেতে খেতে আমার দফারফা অবস্থা।

সে পর্যন্ত দুবার খেজুর গাছ থেকে পড়ে মরতে মরতে বেঁচে উঠেছি। গাবগাছ থেকেও পড়েছি বেশ কয়েকবার। আর বাড়ির পাশে খালের ধারে একটা দইল্লা গাছ ছিল, উন্নার দিনে ওটাতে রসি দিয়ে পিঁড়ির দোলনা বানাতাম; আর বর্ষাকালে এ গাছটা ছিল আমাদের সবচেয়ে মজার জায়গা- করতাম কী, দল বেঁধে গাছের ডগায় উঠতাম, আর ঝাঁকে ঝাঁকে গাছের ডগা থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়তাম। ডুব দিয়ে যে যতো বেশি দূরে গিয়ে উঠতে পারতাম, সে তত সেয়ানা। আমি এ কাজটায় বড্ড সেয়ানা হয়ে গিয়েছিলাম। মা কতো মানা করতেন, কিন্তু আমি কি আর মায়ের হাতের পুতুল?

একদিন আমার এমনি এক বিটকেলির শাস্তি স্বরূপ আমাকে বাম হাতে ধরে ডান হাতে পিঠের উপর দমাদম কিল ঝাড়তে ঝাড়তে মা মুখ দিয়ে আগুন বের করতে লাগলেন- তোর মতো পুলা আমি দুনিয়াতে রাহুম না- আমার কইলজ্যা খাইয়া হালাইলি তুই- পুলার পুলা, ক, গাছে গনে আরো লাফ দিবি? আরো লাফ দিবি?

আর আমার ছিল কইমাছের প্রাণ বা গণ্ডারের শরীর- মায়ের কিলে আমার কোনো ব্যথা হতো না, যদিও পিটুনি খাওয়ার সময় গলা ফাটিয়ে বাবা-বাবা বলে চিল্লানি দিতাম।

একটু বিরতি দিয়ে মা বললেন, তুই জানস তোর মতো পুলারা আইজকাল ইস্কুলে যায়? তোর সুরুজ মামু পরশু দিন গনে ইস্কুলে যাইতেছে। কতো বদ্র অইয়া গেছে সুরুজ।

সুরুজ মোল্লা আমার একমাত্র মামা, আমার থেকে তিন-চার মাসের বড়। মামা আমাদের বাড়ি আসে, তার সাথে কিছুক্ষণ ত্যাঁদরামি করি, সে ত্যক্ত হয়ে কান্নাকাটি করে বাড়ি চলে যায়। মামাও বেশ গোবেচারা বটে, আমার সামনে। সেই মামা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে শুনে আমার কোনো ভাবান্তর হলো না; কেননা 'বদ্র'ই বা কী জিনিস, আর স্কুলে যাওয়ার মাহাত্ম্যই বা কী, গাছে গাছে বাস করার চেয়ে তাতে অধিক আনন্দ আছে কিনা সে বিষয়ে কোনো জ্ঞান তো ছিলই না, জানারও কোনো আগ্রহ ছিল না।

মায়ের পিটুনিতে ব্যথা না পেলেও মা-ই ছিলেন সাক্ষাৎ 'রাক্ষসী', আর বাবা ছিলেন সকল বিপদের নিরাপদতম আশ্রয়স্থল; যতোক্ষণ বাবা বাড়িতে, মা আমার টিকিটিও ছুঁতে পারতেন না, আর আমার থাকতো তখন সাত খুন মাফ।

মা একদিন সন্ধ্যায় বাবাকে মৃদু ক্ষোভের সাথে বলছেন, তোমার বান্দর পুলারে হয় তুমার সাতে ক্ষ্যাতে নিয়া যাইবা, নাইলে ইস্কুলে দিয়া দেও। ওর জ্বালায় আমার জানডা ত্যাজপাতা অইয়া গেলো।
বাবা হাসতে হাসতে বলছেন, কও কী, ইস্কুলের বয়স বড় অইছে নি? বয়স অইলে আল্লায় নিলে ইস্কুলেই বর্তি কইরা দিমু। আমার মতন লাঙ্গল টানবো নি বড় আমার পুলা।
বয়স অইছে না! মা ঝামটা দিয়ে বলেন, সুরুজ ইস্কুলে যাইবার নাগছে কবে গনে। সুরুজ কতো বদ্র অইয়া গেছে দ্যাকছাও না!
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসেন।

এরপরের কিছুদিনের কথা ও ঘটনা আর মনে নেই। মনে পড়ে শুধু কথাগুলো- বাড়িতে প্রস্তুতি চলছে আমাকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। আজ না কাল, কাল না পরশু- এভাবে। বাবা বাড়িতে থাকলেই স্কুলে নিয়ে যাবে একদিন, কিন্তু বাবার সেই সময় আর হয়ে ওঠে না।

বাবার সময় হলো একদিন সকালে। আমার জন্য একটা বই কেনা হয়েছে- সবুজ সাথী। একটা শ্লেট আর মাটির পেনসিলও। সেগুলো গত কয়দিন ধরে নাড়াচাড়া করেছি, আর কেবলই বিষণ্ন হয়েছি যে এগুলোর জন্যই আমাকে স্কুলে যেতে হবে। আমার পুরনো হাফপ্যান্ট আর শার্টটা ৫৭০ সাবান দিয়ে ধুয়ে নতুনের মতো করা হয়েছে। কিন্তু সকালবেলা থেকেই আমার খুব মন খারাপ- খুব কান্না পাচ্ছে। মায়ের 'বদ্র' কথাটার অর্থ আমি না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিলাম যে স্কুলে গেলে আমিও সুরুজ মামার মতো 'বদ্র' হয়ে যাবো- হায়রে, আমার দিনভর গাছগাছালি খেলা- এসব তো আর কিছুই করতে পারবো না- আমি তবে কিসের লোভে স্কুলে যাবো?

স্কুলে যাবার সময়টাতে পাড়াপড়শিরা ও বাড়ির সবাই জড়ো হলো আমাদের ঘরের সামনেটায়, আর ঠিক তখনই ডুকরে কাঁদতে শুরু করলাম। যতোই সময় ঘনিয়ে আসতে লাগলো বাড়ি হতে বের হবার, আমার কান্নার বেগ ততোই বাড়তে লাগলো, একসময় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম- আমি ইস্কুলে যামু না। ইস্কুলে যামু না। আর আমার কান্না তখন এতোই করুণ হয়ে উঠেছিল যে বাবা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেও কেঁদে দিয়ে মাকে বললেন, তাইলে আইজক্যা বাদ দেই? কিন্তু মা শাসিয়ে উঠতেই বাবা আমার হাত ধরে বললেন, চলো বাজান- কাইন্দো না- ইস্কুল অনেক বালো জাগা।
আহারে কী কান্না না করেছিলাম সেদিন- আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছি আর আমাকে বাড়িভর্তি মানুষজন দেখছে- আমি আমার সোনার দিনগুলো ফেলে চলে যাচ্ছি অন্যদিনের দিকে...

স্কুলে আমি ভালো করছিলাম। কয়েক বছরের মধ্যে পাড়াপড়শি ছাড়িয়ে পুরো গ্রামে আমার মেধার কথা ছড়িয়ে পড়লো। লোকে বলতে লাগলো- গোবরে পদ্মফুল।

আমার অজপাড়াগাঁয়ের স্কুলটাতে আমিই প্রথম প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেছিলাম- এই বৃত্তির খবর নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ তিনজন শিক্ষক ও কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি যখন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন- আমার মা হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছিলেন।

আমার মা মারা গেছেন আমি যখন ৭ম শ্রেণীতে পড়ি। প্রাইমারি স্কুল থেকে হাইস্কুলে যেয়েও আমি স্কুলে খুব ভালো করতে থাকি- আমার মা এ খবরে অতি আপ্লুত হয়ে বলতেন- তর মনে আছে, ইস্কুলে যাইবার দিন তুই কতো কাঁনছিলি?

ফেলে আসা দিনের অবিস্মৃত অনেক কিছুর মধ্যে স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিনটির কথা এভাবেই আমার ভেতর সতত ঝলমল করে আলো দেয়.........


রবীন্দ্রনাথের যে বইটি আমি প্রথম পড়েছিলাম

অনেকে মিটিমিটি হাসছেন- আমাকে হয়তো 'প্রথম' মুদ্রাদোষে পেয়ে বসেছে। একদম ঠিক। মাথায় কিছু আসছে না- না কবিতা, না গল্প, না অন্যকিছু। এ অবস্থায় বেশ কিছুদিন চলে যাওয়ার পর হঠাৎ হঠাৎ একেকটা জিনিসের কথা মনে পড়ে আর নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করি- কবে যেন প্রথম এটা করেছিলাম!
এইতো সংক্ষিপ্ত পটভূমিকা।

মোটামুটি ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত আমি বইয়ের পোকা ছিলাম- সামনে যা পেতাম গোগ্রাসে কাটতাম আর চিবুতাম। তবে আপনাদের মতো অতো না আবার।

কিন্তু এতো বই কোথায় পাবো? সপ্তম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায়ই নবম-দশম শ্রেণীর বাংলা বই পড়ে ফেলেছি- বিশেষ করে গল্পগুলো। সেকালে আমাদের অজগ্রামে কেন, হাইস্কুলেও কোনো খবেরের কাগজ যেতো না। স্কুলে যে একটা লাইব্রেরী আছে তাও জানতে পেরেছিলাম অনেক পরে।

তো, এতো বই কোথায় পাবো? কিনে বই পড়ার মতো সামর্থ্য আমার ছিল না। তবে এখানে-সেখানে 'চটি' জাতীয় কিছু বই মাঝে মাঝেই ক্লাসমেটরা একত্র হয়ে রসিয়ে রসিয়ে পড়ি- এক হাত থেকে আরেক হাতে যেতে যেতে একসময় ভুলে যাই এর মালিক কে ছিল- ভুলে যাই বর্তমানে বইটা কোথায় কার কাছে আছে।

খুব পড়ুয়া পরিবারের দু-তিনজন ক্লাসমেট ছিল। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের দিন, যেমন নজরুল-রবীন্দ্র-জসীম উদ্‌দীন জন্মজয়ন্তীতে তাঁদের কবিতার বই ওরা নিয়ে আসতো। ওদের কাছ থেকে নিয়ে পড়তাম। বাসায় নিয়ে যেতাম। আমার এই পড়ার নেশা সম্বন্ধে ওরা যখন বুঝতে পারলো, নিজেরাই বললো- আমাদের বাসায় তো কাঁড়ি কাঁড়ি বই, পড়ার কেউ নাই। তুই পড়বি নি? পড়বার পারোস।

ওর নাম জাহিদ। বললাম, কাল আমার জন্য একটা বই নিয়া আসিস।

জাহিদ পরের দিন আমার হাতে যে বইটা এনে তুলে দিল ওটার মলাট ছিল না। মলাটের পরের সাদা পাতাটা ময়লা আর ছেঁড়াছেঁড়া মতো হয়ে গেছে। তাতে কী- বইটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উলটাতে থাকি।

শেষের কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি তখন সপ্তম অথবা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি, সঠিক মনে নেই। পাঠ্যপুস্তকে কবি-পরিচিতি আর শিক্ষকদের কাছ থেকে শোনা জ্ঞান থেকে অল্প অল্প চিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- কাজী নজরুল ইসলাম- আর জসীম উদ্‌দীন। স্কুলে খুব আড়ম্বরের সাথে এঁদের জন্ম বা মৃত্যুদিবস পালিত হয়, অন্য কবিদের না- পাঠ্য বইয়ের কবিতা বা আর কারো কাছে পাওয়া বই থেকে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠানে তাঁদের কবিতা পড়ি। তাঁদের সম্বন্ধে আর কতোটুকুই বা জানি!

আমি শেষের কবিতা পড়তে শুরু করি। ক্লাসের পড়া, বাড়ির কাজ আর খেলাধুলার সময় সহ বইটা পড়ে শেষ করতে আমার চার-পাঁচ দিনের মতো লাগে।

বইটা পড়ার সময় বিশেষ কয়েকটা অংশে আমি খুব আপ্লুত হয়ে পড়ি।

ভীরু যতীন্দ্র লাল চুপিসারে লাবণ্য'র ড্রয়ারে চিরকুট লুকিয়ে রাখতো- যাতে লেখা থাকতো লাবণ্য'র প্রতি তার নিবেদন, কিন্তু মুখ ফুটে বলার দুঃসাহস তার কোনোদিন হয় নি।

আরেকবার লাবণ্য অমিতকে নিয়ে চলে যায় সেই পাহাড়ের ধারে কোনো এক গোধূলিবেলায়, যেখানে দাঁড়িয়ে এমনি আরেকদিন লাবণ্যকে সে একটি আংটি পরিয়ে দিয়েছিল- লাবণ্য সেদিন এটা ফিরিয়ে দেয়।

বইটার এক জায়গায় গিয়ে আমার খুব খারাপ লেগেছিল, কান্না চলে এসেছিল। অমিত যোগমায়াদের বাড়ি গেছে। কিন্তু যোগমায়ারা আর আগের বাড়িতে নেই। "ঘর বন্ধ, সবাই চলে গেছে, কোথায় গেছে তার কোন ঠিকানা রেখে যায় নি'।" অমিত লাবণ্যের বসবার ঘরে গেল। "সেই ঘরটার মধ্যে বোবা একটা শূন্যতা। তাকে প্রশ্ন করলে কোন কথাই বলতে পারে না। সে একটা মূর্ছা, যে মূর্ছা কোনোদিনই আর ভাঙবে না।" তারপর অমিত নিজের কুটিরে গেল। যোগমায়া যা যেমন রেখে গিয়েছিলেন তেমনি সব আছে। এমন কি, যোগমায়া অমিতকে দেয়া তাঁর কেদারাটিও ফিরিয়ে নিয়ে যান নি। যেন স্নেহ করেই এই কেদারাটি তিনি অমিতকে দিয়ে গেছেন। অমিত যেন শুনতে পেল শান্ত মধুর স্বরে তাঁর সেই আহ্বান - 'বাছা'!

আর সবচেয়ে খারাপ লেগেছে লাবণ্য'র লেখা কবিতাটা, যা সে অমিতকে লক্ষ্য করে লিখেছিল :

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও
তারই রথ নিত্যই উধাও

বুকের ভেতর মোচড় দিয়েছিল এ কথাটা- হে বন্ধু বিদায়। আমার সেই কচি মনে কেবলই মনে হতো- এরপরও আরেকটু থাকতে পারতো, এ কবিতার উত্তরে অমিতের কিছু একটা, তাহলে হয়তো মনটা প্রশমিত হতো। এমন ভেবেছি আরো অনেক অনেক বার।

এরপর আরো বহুবার শেষের কবিতা পড়েছি। শেষের কবিতা সম্বন্ধে অনেকেই বলে থাকেন- এ উপন্যাস পাঠের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই, এটা সর্বকালের সব বয়সের পাঠকের জন্য উৎকৃষ্ট ও যথোপযুক্ত রচনা- আপনি যে বয়সেই পড়বেন, মনে হবে আপনার বয়সের জন্যই এটা লেখা হয়েছে- আপনি যতোবার পড়বেন, ততোবারই এটা আপনার কাছে আনকোরা নতুন মনে হবে- মনে হবে এই কথাটা, এই লাইনটা তো আগের বার পড়ি নি।

নবম শ্রেণীর মাঝামাঝি সময় থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত আমাকে এমনভাবে পেয়ে বসলো যে বলতে গেলে অন্য কোনো গানই আমার ভালো লাগতো না। এই ভালো লাগার মূলে ছিল শেষের কবিতা, আর রবীন্দ্র সঙ্গীত রক্তের ভেতর ঢুকে যাওয়ার পর একদিন অনুভব করি- আমার রক্তকণিকায় শুধু গান আর সুরের তরঙ্গই বয়ে যাচ্ছে- অবিরাম অবিরল কলকল ছন্দে।


আমার চাচা কি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না?

যুদ্ধ শুরু হবার ক'মাস পরই আমার একমাত্র চাচা চাকরির সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। আমার বুড়ো দাদী ছেলের জন্য কেবলই কাঁদতেন। কাঁদতে কাঁদতে চাচীর চোখ সারাক্ষণ ফুলে থাকতো।

চাচা বাড়ি ফিরেছিলেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর। আমরা অবশ্য ধরেই নিয়েছিলাম চাচা আর বেঁচে নেই।

সেই চাচা পুলিশের পোশাক পরে বাড়ি ফিরে এসে দাদীকে জড়িয়ে ধরে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠেছিলেন। চাচার গায়ে পুলিশের পোশাক দেখে প্রথমে আমি ভয়ই পেয়েছিলাম পুলিশভীতির জন্য। আসলে পুলিশ নয়, বাড়ি থেকে বের হয়ে চাচা আনসার বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন।

সন্ধ্যায় খাওয়া দাওয়ার পর পরই দুয়ারে বিছানা বিছিয়ে চাচাকে ঘিরে বসে পড়তাম আমরা। চাচা যুদ্ধকালীন ভয়াবহ দিনগুলোর কথা বর্ণনা করতেন একনাগাড়ে। তাঁর কথা শুনে আমাদের গা শিউরে উঠতো।

বড় হয়ে বাড়ি ছাড়লাম, পড়ালেখা ও জীবিকার জন্য। বাড়িতে গেলে কোনো কোনো অবসরপূর্ণ সন্ধ্যায় আগের মতোই চাচার মুখে সেই যুদ্ধের কাহিনী শুনতে বসে পড়তাম। ২৫-৩০ বছর আগের কথা কি ঝলমলে ভাষায় বলে যেতেন চাচা, যেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সদ্য ফেরত এলেন।

একটা আশ্চর্য ভাবনা মাত্র কয়েক মাস আগে থেকে আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। চাচার কাছে তো কোনো মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র ছিল না- মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় কি তাহলে চাচার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল?

মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র, নামীয় তালিকা হালনাগাদকরণ- বড় হয়ে এই বার্নিং ইস্যুগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হবার অনেক সুযোগ হয়েছে আমার- কিন্তু আশ্চর্য, একটি দিনের জন্যও আমার মনে হয় নি, দেখি তো চাচার নামটা কোন্‌ সেক্টরে দেখানো হয়েছে- দেখি তো চাচার নামটা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিনা- আশ্চর্য, ঘুণাক্ষরেও এ বিষয়টি আমার মনে উঁকি দেয় নি। এমনকি আমার চাচাকেও কোনোদিন বলতে শুনি নি- আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। শুধু যখন যুদ্ধের দিনগুলোর কথা আলোচনা প্রসঙ্গে কোথাও উঠে আসতো- দেখতাম কি অনর্গলভাবে চাচা বলে যাচ্ছেন- কিভাবে জঙ্গলে জঙ্গলে রাত কাটাতে হয়েছে- গুলিবিদ্ধ সহযোদ্ধাদেরকে কিভাবে তাঁরা শুশ্রূষা করেছেন- এসব।

নিজেকে যখন খুব অপরাধী মনে হলো- তখন একবার মনে মনে ভাবলাম খুঁজে দেখি চাচার নামটা সত্যিই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আছে কিনা। পরক্ষণেই ভাবলাম- কী লাভ, চাচার নামটা কোথাও খুঁজে না পেলে তো শুধু আমার কষ্টই বাড়বে, আর কিছু না তো। আমার দরিদ্র চাচা জীবিতাবস্থায় জীবিকার জন্য অনেক কঠিন সংগ্রাম করে গেছেন, তিনি হয়তো জানতেনও না 'দরিদ্র' মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার থেকে কী কী সুবিধা দেয়া হচ্ছে, এ নিয়ে তাঁকে কোনোদিন একটা কথাও বলতে শুনি নি সরকারে বিরুদ্ধে- যুদ্ধ করলাম, অথচ সরকার আমারে কিছুই দিল না।

আমার চাচার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় না থাকলে এমন কীই বা ক্ষতি আমার বা চাচার পরিবারের? তাতেই তো আর প্রমাণিত হলো না যে আমার চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। আমার চাচা যে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার সবচেয়ে বড় দলিল তো আমি নিজে- এখনো চোখের সামনে উজ্জ্বল ভাসে- যুদ্ধ শেষ হবার পর কোনো এক বিকেলে চাচা বাড়ি ফিরে এলেন- আমার দাদী 'আনছের আনছের' বলে চাচার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন- সেই দৃশ্য আজও এতোটুকু ম্লান হয় নি।

আমার মুক্তিযোদ্ধা চাচা দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভোগার পর ২০০৬ সনের ১৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। আপনারা আমার চাচার রুহের মাগফেরাত কামনা করবেন প্লিজ।


বিদেশের মাটিতে দেশের স্মৃতি

আমি জীবনের একেকটা সময়ে একেকটা জিনিসের পোকা ছিলাম।

খুব ছোটবেলায় ঘুড়ি উড়ানোর পোকা ছিলাম।
ষষ্ঠ থেকে ১২শ শ্রেণী পর্যন্ত বইয়ের পোকা। ঠিক এই সময়েই রেডিও'র পোকাও ছিলাম। ঘুমানোর সময় কানের কাছে মৃদু ভলিয়্যুমে রেডিও ছেড়ে রাখতাম, স্বপ্নের ভেতর গান শুনবো বলে। এর একটু পরে ক্যাসেট প্লেয়ারের পোকা হয়ে পড়লাম। নতুন ক্যাসেট বেরোলেই কিনে ফেলা, পছন্দের গান রেকর্ড করা। রাতভর ননস্টপ গান ছেড়ে রাখা আর স্বপ্নের ভেতর গান শোনা(পার্শ্ববর্তীরা কেউ কেউ উপভোগ করতেন, বেশির ভাগই বিরক্ত হতেন)।

এর পরের সময়টা খুব ভয়াবহ ছিল। আমি টিভির পোকা হয়ে গেলাম। তখন শুধু একটাই চ্যানেল- বিটিভি; পৌনে তিনটার সময় প্রাক-অনুষ্ঠানাদি শুরু হতো, তিনটায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে চলতো সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। কোরআন তেলাওয়াত ও বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর মধ্য দিয়ে দিনের অনুষ্ঠান শেষ হতো। আমি খুব মনমরা হয়ে টিভিরুম ছাড়তাম।

১৯৯৩-এ আইসিসিতে কেনিয়ার কাছে পরাজয়ের মাধ্যমে ১৯৯৬ বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের খেলার স্বপ্ন তিরোহিত হয়ে গেলে যে কষ্ট পেয়েছিলাম, ১৯৯৭-এ সেমিফাইনালে আয়ারল্যান্ডকে হারানোর মাধ্যমে ১৯৯৯-বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলার সোনার ভিসা পেয়ে গেলেও ১৯৯৩-এর ক্ষত বুকের ভেতর রয়েই গেলো। তবে আমি ক্রিকেটের পোকা হয়ে গেলাম ১৯৯৩-এ বাংলাদেশের হারের পর থেকেই- খেলোয়াড় হিসেব খুব সামান্যই, তবে ক্রিকেট সাবজেক্টটা আমার কাছে সবচেয়ে স্মার্ট, আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য হয়ে উঠলো; ক্রিকেটের যাবতীয় তথ্য হাতের কাছে চলে এলো। ক্রিকেট উন্মাদনা চললো ২০০৪ পর্যন্ত। এর মাঝখানে ২০০১-এ বছর খানেকের জন্য বিদেশে ছিলাম, সেখানে স্যাটেলাইটে ক্রিকেট দেখার সুযোগ না পেলেও ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের সর্বকালের সেরা সময়টা কাটিয়েছি সেখানেই। ইন্টারনেটে ক্রিকেট আমার নেশা হয়ে গেলো। আমার ঘুম, নাওয়া-খাওয়া হারাম হয়ে গেলো, আমি ক্রিকেটের নানান তথ্য ডাউনলোড করি আর একের পর এক সিডিতে তা রেকর্ড করি।

এ লেখাটায় যা লিখবো তা হলো সেই বিদেশের দিনগুলোর কথা।

মানুষ কোনো কিছুরই দীর্ঘদিন ধরে পোকা হয়ে থাকতে পারে না, একঘেঁয়েমি দানা বাঁধে ধীরে ধীরে। বিদেশের মাটিতে এক সময় ইন্টারনেটও আর মন ধরে রাখতে পারলো না। দেশের মাটিতে, অনেক অনেক দূরে, ১৪ হাজার মাইল দূরে, বউয়ের ছবি, ছেলের ছবি, মেয়ের ছবি, বাবার ছবি, মায়ের ছবি, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধবদের ছবি খুব করুণ ভাবে চোখে ভেসে ওঠে, আর নীরবে চোখের কোণা জ্বলে যেতে থাকে।

এই বিষণ্ণতা কাটানোর কতো রকমের পদ্ধতি আমাদের।

এর আগে একবার পাকিস্তান গিয়েছিলাম মাস তিনেকের জন্য। সেখানেও এরকম হোমসিকনেস পেয়ে বসেছিল। কী আর করা, সস্তায় একটা ৭ ইঞ্চি রঙিন টিভি কিনেছিলাম।

পাকিস্তানের সেই ছোট্ট টিভিটা এবার আমার রুমে। রুমমেটের একটা ভিসিআর আছে, আমার আছে আরেকটা ক্যাসেট প্লেয়ার। বিকেল হলেই আমাদের রুমে আড্ডা বসে। আমরা ৩-৪ হালি বসে যাই তাস খেলতে।

আমরা তাস খেলি, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে আমার ক্যাসেট প্লেয়ার বাজে। আমার অনেকগুলো ক্যাসেটের মধ্যে একটা ক্যাসেটে আরও বছর আষ্টেক আগে রেকর্ড করা কিছু নির্বাচিত গান ছিল। সেই ক্যাসেটটা বাজে। এ ক্যাসেটের গানগুলো সঙ্গত কারণেই আমার প্রিয় গান।

একদিন খেলা চলাকালীন সময়ে অন্য আরেকটি ক্যাসেট বাজাতেই সবাই সমস্বরে বলে উঠলো : তোমার ঐ ক্যাসেটটাই লাগাও।

রাত ২-৩টা পর্যন্ত আমাদের রুমেই খাওয়া-দাওয়া চলতো, তাস খেলা ও আড্ডা দেয়া চলতো। আর মাঝে মাঝে ছবি দেখা।

সব ছবি যখন শেষ হয়ে গেলো, তখন আমরা বাংলাদেশী বাংলা ছবি দেখা শুরু করলাম। দেশ থেকে বাংলা ছবি পাঠানো হতো। মনে হতো, এসব বাংলা ছবির চেয়ে ভালো কোনো ছবিই হতে পারে না। শাহনাজ, শাবনূর, একা, পপি নামে যে বাংলাদেশী বেশ কিছু ভালো নায়িকা আছে, বিদেশের মাটিতে না এলে হয়তো তাঁদেরকে চেনাই হতো না। জেনিফার লোপেজ বা ঐ সময়ের হটকেক কারিনা কাপুরকে খুব নস্যি মনে হতে লাগলো। কারো প্রিয় নায়িকা শাবনূর, কারো একা, কারো পপি, ইত্যাদি.....

সবাই যখন যার যার মতো রুমে চলে যেত, একটা ছেলে রয়ে যেত। খালেদ। ওর তিনটা মেয়ে। প্রথমটার বয়স ৮, পরের দুটো টুইন, ৩-৪ বছর হবে হয়তো।

খালেদ নিজে নিজেই ক্যাসেট প্লেয়ার অন করতো। রিওয়াইন্ড বা ফরওয়ার্ড করে ও দুটো গানই বার বার শুনতো। শুনতো আর চোখ মুছতো।

ঐ গান দুটো আমারও খুব প্রিয়। আমি আজও পরিবার ছেড়ে দূরে কোথাও গেলে ঐ গান দুটো খুব শুনি আর কাঁদি।

প্রিয় বন্ধুরা, শুধু এই গান দুটোর জন্যই এই দীর্ঘ বাতুলতা।

স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে পানি টলোটল মেঘনা নদীর কাছে আমার অনেক ঋণ আছে
আমার মনপাখিটা যায়রে উড়ে যায় ধানশালিকের গাঁয় নাটাবনের চোরাকাঁটা ডেকেছে আমায়


আমার দেখা প্রথম ছায়াছবি
০৫ ই মে, ২০০৯ সকাল ১১:৫১

দশ-এগার বছর বয়সের কালে মায়ের চোখে ধূলি দিয়ে দুই মহাধূরন্ধর বন্ধুর সাথে পদব্রজে বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরবর্তী জয়পাড়া সিনেমা হলে গিয়ে জীবনের প্রথম ছায়াছবিটি দেখে রাত দশটার দিকে বাড়ি ফিরে এসে মায়ের হাতের সালুন নাড়ার লাঠিতে বেধড়ক ধোলাই খেয়ে আমাকে একটুও কাঁদতে হয় নি। সিনেমা দেখার উত্তেজনা ও আনন্দ এবং বিস্ময়ে আমি এতোখানিই ঘোরের ভেতর ডুবে গিয়েছিলাম যে এসব জাগতিক বিষয়আশয় তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ের চেয়েও গৌণতর জ্ঞান হচ্ছিল। এরপর অবশ্য প্রায় মাস দেড়েকের মতো আমাকে ঘরের ভেতর অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল; আমি নাকি সেয়ানা হয়ে গেছি, রাতবিরাতে ঘরের বাইরে থাকি, এই সেয়ানাগিরি ছোটানোর জন্য মায়ের এই কার্ফিউ ব্যবস্থা ছিল।

ছবির নাম বুলবুল-এ-বাগদাদ।

ছবি দেখার খায়েস অনেক আগে থেকেই ছিল। আর ছায়াছবি নামে যে অত্যাশ্চর্য একটা বস্তু আছে তা অবশ্য জানতে পেরেছিলাম এর বছর দেড়েক আগে, যখন জয়পাড়া বাজারে প্রথম বারের মতো প্রেক্ষাগৃহ তৈরি হলো। পুরো দোহার, শ্রীনগর ও নবাবগঞ্জ উপজেলা মিলিয়ে দ্বিতীয় আর কোনো সিনেমা হল তখন ছিল কিনা সে সময়ের জ্ঞান নিয়ে তা জানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। শুধু এটুকু ভাবা খুব সহজ ছিল, ইশ, আমাদের বাসা যদি ঢাকা শহরে থাকতো তাহলে সবগুলো সিনেমা হলে ঘুরে ঘুরে এক সপ্তাহে অনেকগুলি ছবি দেখতে পারতাম।

সিনেমা হলে ঢুকেই দেখি একেবারে প্রথম সাড়িতে আরেক মহাধূরন্ধর ক্লাসমেট। আমি পাশের দুজনকে বলি, ঐ, সামনে তো কতো সিট খালি, চল্‌ সামনে যাইয়া বসি।
ওরা দুজন সেয়ানারও সেয়ানা। আমাকে ধমক দিয়ে বলে, চোপ ভোদাই, ঐডা অইল থার্ড ক্লাস, আমরা বইছি সেকেন্ড ক্লাসে।
আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগলো। সামনের সারিটা থার্ড ক্লাস হয় কিভাবে? আমি নিজেকে মনে মনে একটু বেশি বুদ্ধিমান ভাববার চেষ্টা করি, আর বলি, তোমরা ভোদাই কিচ্ছু জানো না।
এর পরের দুবার আমি সামনের সারির টিকিট কিনেছিলাম; আর সামনের সারিটা কেন যে ফার্স্ট ক্লাস না হয়ে থার্ড ক্লাস হলো, তা বুঝতে আমার আরও বছর খানেকের মতো সময় লেগেছিল।

পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে সবাই দাঁড়িয়ে গেলো। আমিও দাঁড়ালাম। শরীরে এক প্রচণ্ড অনুভূতি, যা বোঝানোর কোনো ভাষা নেই। সামনে এতোক্ষণ একটা ধবধবে সাদা পর্দা ছিল। ছবি শুরুর আগে সঙ্গী দুজনকে একের পর এক প্রশ্নে ঝাঁঝরা করে ফেলেছি- এতোটুকু জায়গায় জীবন্ত একটা শহর বা গ্রামের মানুষেরা কিভাবে চলাফেরা করে? ছবির মানুষগুলো কি সত্যিই নড়াচড়া করে, নাকি বায়স্কোপের মতো একের পর এক ছবি ভেসে ওঠে পর্দায়? সঙ্গী দুজনের মুখে ছবির গল্প শুনতে শুনতে আমার মনে এসব প্রশ্ন দেখা দিত।

জাতীয় পতাকা নামতেই তীব্র খটাখট খটাখট শব্দে কয়েক সারি ঘোড়া চোখের সামনে দিয়ে মরুভূমির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের দিকে ছুটে গেলো। এরপর আরো কয়েক সারি ঘোড়ার দুরন্ত ছোটাছুটি। আমি যুগপৎ বিস্মিত, চমৎকৃত ও উল্লসিত, আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছে, চোখের সামনে যা দেখছি তা আমার কল্পনার জগৎ ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরের এক মহাবিস্ময়।

একটা ঘোড়া থামলো। ঘোড়ার পৃষ্ঠ থেকে নেমে খট খট কদম ফেলে যে অতিশয় সুদর্শন রাজকুমার রাজদরবারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে- সঙ্গীরা জনালো তাঁর নাম ওয়াসীম। আমি সত্যিই বিমোহিত হয়ে গেলাম ওয়াসীমের সোন্দর্য দর্শনে।

এরপর কিছু জাদুদৃশ্যও বোধ হয় ছিল। বিকট চেহারার এক দৈত্য ও তার অট্টহাসি দেখে ভয় পাচ্ছিলাম। সঙ্গীরা জানালো- তার নাম জাম্বু।

মাঝে মাঝেই তরবারি-যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ আর ঘোড়দৌড় আমার কাছে সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল।

আমার ঘোরলাগা বিস্ময় আকাশ ছুঁলো রাজকুমারীর দৃশ্যে। রাজকুমারী তার শয়নকক্ষে শায়িতাবস্থায় ছিল; সেখানে রাজকুমার ওয়াসীমের প্রবেশ। চমকে শোয়া থেকে উঠে বসে রাজকুমারী, আর এ দৃশ্যটা তিনবার করে দেখানো হচ্ছিল। ও-বয়সেই রাজকুমারীর রূপলাবণ্য দেখে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। আমার কী যে ঘোর লেগে গেলো!
রাজকুমারীর নাম অলিভিয়া।
তারপর বিশ্বাস করুন, জীবনে কতো নায়িকাদেরই তো দেখলাম, অলিভিয়া জীবন ভর আমার কাছে স্বপ্নের রাজকন্যা হয়েই থাকলো, তার মতো অপরূপা সুন্দরী নায়িকা আর কাউকেই পেলাম না।

বিপুল উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনার ঘোরে ছবি দেখা শেষ করে রাত সোয়া নয়টার দিকে জয়পাড়া সিনেমা হল থেকে আমরা ত্রিরত্ন মায়ের কোলে ফিরে আসতে হাঁটা ধরলাম।

বিনীত নিবেদন : কেউ যদি দয়া করে অলিভিয়ার একখানা ছবি এখানে পেস্ট করেন, কৃতজ্ঞ থাকি।





**বিভিন্ন সময়ে লেখা হয়েছিল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন