রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১০

ই-ফ্রেন্ড



পর্ব-১

বিছানায় ডানকাত হয়ে কনুইয়ের ওপর ভর করে অর্ধ-শুয়ে আছে শাহিদ। ডান হাতে রিসিভার তুলে কানের কাছে ধরা, বাম হাতের শাহাদাৎ আঙ্গুলে চাপ দিয়ে কিছুক্ষণ ক্র্যাডলটি বসিয়ে রাখে, আবার সে ছেড়ে দেয়। মনে তার প্রচুর দ্বিধা। জীবনে এটাই যে প্রথম তা-ও নয়, তবু তার দ্বিধার অন্ত নেই। অপর প্রান্তে যদি সত্যি সিত্যই একটা মেয়েকণ্ঠ মিষ্টি স্বরে বলে ওঠে জ্ঞহ্যালোঞ্চনতখন সে কী বলবে? এর আগে বেশ কয়েকবার সে এমন অপরিচিত নম্বরে ফোন করেছিলনঅপর প্রান্ত থেকে ভেসে এসেছেন স্লামালেকুম, রমনা থানা থেকে সেকেন্ড অফিসার ফারুক বলছিনঅমনি সে জ্ঞস্যরি, রং নাম্বারঞ্চ বলে ক্যাচ করে লাইন কেটে দিয়ে ধপ করে রিসিভার নামিয়ে রেখে ঘেমে উঠেছে। কখনো বা দরাজ গম্ভীর গলায় কোন এক পুরুষকণ্ঠ লম্বা স্বরে টেনে টেনে বলে উঠেছে জ্ঞহ্যালোঞ্চ, সে ভীত কণ্ঠে মিনমিন করে বলেছে, এটা কি ষ্টেডিয়াম মার্কেট? অপর প্রান্তে জি না, রং নাম্বার বলে লাইন কেটে দিয়েছে। আরেকবার এক কর্কশ নারীকণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠলো, হ্যালো.......। শাহিদ দ্বিধান্বিত স্বরে জিঞ্চাসা করলো, এটা কি সুমনা রহমানের বাসা? কাষঠস্বরে কানফাটানো জবাব মেলেনজ্বে।
তাঁকে একটু দেয়া যাবে?
উনি তো বাড়িত নাইক্যা।
কোথায় গেছেন?
উনার ছোট নাতির মুসলমানি তো, সেইখানে বেড়াইতে গেছে।
আর কোন কথা নয়, সে মহাবিরক্ত হয়ে লাইন কেটে দেয়।
এ রকম দোটানার মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ সে টেলিফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করলো। তারপর সকল ভাবনার অবসান ঘটিয়ে ডায়াল করলোঃ ৭৪১৭০৯৯।
রিং যেতে থাকেনক্রিংক্রিংনক্রিংক্রিন। রিং বাজার মতো তার হৃৎপিণ্ডও ধপধপ করে বাজতে থাকে। সাতটি রিং বাজার পর অপর প্রান্ত থেকে রিসিভার তুলে একটা অদ্ভুত মিষ্টি কণ্ঠ মৃদু জড়তাগ্রস্ত স্বরে বলে উঠলো, হ্যালো স্লামালাইকুম। মুহূর্তক্ষণের জন্য শাহিদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলনতার কণ্ঠও প্রায় রুদ্ধ হয়ে এলো।
মেয়েটি আবার মোলায়েম স্বরে বলে ওঠে, হ্যালোনহ্যালো।
অত্যন্ত কাঁপা স্বরে শাহিদ বলে, স্লামালাইকুম, এটা কি ৭৪১৭০৯৯?
মেয়েটি নরম ও ধীর গলায় টেনে টেনে বলে, জ্বি। কাকে চাই প্লিজ?
কাকে চাই আমি ঠিক জানি না। তবে আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি? বেশি নয়, খুব অল্প সময়ের জন্য?
আপনার কথাগুলো কিন্তু ব- অদ্ভুত। এটা কি বোকার মতো বলা হলো না যে আপনি কাকে চান তা জানেন না? মেয়েটির কণ্ঠস্বর সামান্য রূঢ় হয়।
আই এ্যাম এক্সট্রেমলি সরি দ্যাট আই এ্যাম এ ফুল। দুঃখিত স্বরে শাহিদ বলে।
ইটস ওকে। কিন্তু এ নামবারটি কোথা থেকে পেলেন বলুন তো?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন কোথা থেকে পেয়েছি। জানেন না?
সিওর হতে পারছি না। বলুন না প্লিজ, কোথা থেকে পেয়েছেন?
বলছি। কিন্তু বলবোই বা কেন? আমিই তো একমাত্র এবং প্রথম মানুষ নই যে আপনাকে ফোন করছে।
প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, আমি আপনার সাথে কথা বলতে ইন্টারেস্টেড নই।
আই এ্যাম স্যরি। কিন্তু অন্তত এটুকু শুনবেন তো এ নাম্বারটি কোথা থেকে পেলাম?
আমি কিন্তু কয়েকবারই জানতে চেয়েছি, আপনি ভণিতা করছেন।
বলছি ম্যাডাম, আপনার নাম্বারটি পেয়েছি ইন্টারনেট থেকে।
আমিও ঠিক তাই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখুন?
জ্বি?
আপনার কি বিশ্বাস হয় যে ইন্টারনেটের কথাগুলো সত্যি?
সত্যি নয়?
আসলে যা লেখা আছে তা সবই ভুল।
ভুল? ভুল কথাগুলো তাহলে লিখলেন কেন?
আমি লিখবো কেন? ওগুলো আমি লিখিনি। কে যে লিখেছে তাও বুঝতে পারছি না। গত সাতটা দিন ধরে বদমাশ ছেলেগুলো একের পর এক ফোন করে আমাকে পাগল করে ছাড়লো।
শাহিদ একটু ঢোক গিলে, কারণ মেয়েটির বিবেচনায় সে-ও নিশ্চিত ঐ বদমাশ ছেলেদের দলেই পড়ে। কিন্তু অল্পক্ষণেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে ফেলে বলে, এটা কিন্তু আপনি ভুল করছেন।
কোন্টা?
ফোন এলে রিসিভার তোলেন কেন? না তুললেই ঝামেলা চুকে যায়।
আত্মীয় স্বজনের ফোন হতে পারে না?
অন্য কাউকে ফোন ধরতে বলুন।
আপনার এ্যাডভাইসটা আমার খুব খাটলো।
কিন্তু আমার খুব ক্ষতি হলো মনে হচ্ছে।
জ্বি?
স্যরি, কিছু না।
আচ্ছা, আপনার কি ইন্টারনেট সম্বন্ধে ভালো জানা আছে?
ভালো তো নেই, তবে চালিয়ে যাবার মতো স্কিল আমার আছে।
আমাকে তাহলে অবশ্যই হেলপ করতে হবে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলুন কি ধরণের হেলপের প্রয়োজন?
ইন্টারনেট থেকে আমার ডিটেইল ইনফরমেশন মুছে ফেলতে হবে।
ওটা কি সত্যিই আপনি করেননি?
আমাকে মিথ্যুক ভাবছেন?
স্যরি, আমি তা বলছি না। কিন্তু তাহলে বোধ হয় আমার দ্বারা আপনাকে হেলপ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কেন?
আপনার ইউজার আইডি ও পাস-ওয়ার্ড লাগবে, লগ-ইন করে আপনার ইন্টারনেট এ্যাকাউন্টে ঢুকতে হবে। অপশন্স লিংকে গিয়ে আপনার সম্পর্কে সমস্ত তথ্য এডিট করতে হবে, অর্থাৎ ডিলিট করে দিতে হবে।
আপনার কথা কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।
শাহিদ হাসতে হাসতে বলে, তবে আমি কিন্তু একটা জিনিস পরিস্কার বুঝতে পেরেছি।
বলুন তো কী বুঝতে পেরেছেন?
এটা যে সত্যিই আপনি করেননি আমি এখন সে সম্পর্ক সেন্ট পার্সেন্ট কনফার্ম।
কিন্তু কে করলো এটা? তার লাভই বা কী?
আপনি নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী, তাই না?
যাহ্, মোটেও না। মেয়েটি হাসির ঝংকার তুলে বলে, আমার গায়ের রং হাঁড়ির মতো ঝিম কালো।
তাই? বলে শাহিদও হাসতে থাকে।
হাসছেন যে? আমি কি হাসির কিছু বলেছি? মেয়েটি অনুযোগ করে বলে।
মোটেও না।
তাহলে?
তাহলে, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি?
করুন।
উত্তর দিবেন তো?
আগে করেই দেখুন না। উত্তর দেয়ার মতো হলে অবশ্যই দিব।
তাহলে করবো না।
ঠিক আছে।
আপনাকে অযথা বিরক্ত করলাম।
আশা করি আর করবেন না।
আপনি কিন্তু বেশ জেদী এবং ভয়ানক নিষঠুর।
এটা অনেকেই বলে।
আর কে কে বলে জানতে পারি কি?
আমার শ্বশুর বাড়ির সবাই বলে।
আপনি বিবাহিতা?
কেন, ইন্টারনেটে লেখা ছিল না?
ইন্টারনেটে লেখা ছিল, জ্ঞআই এ্যাম এ কলেজ গার্ল, আনম্যারিড, আই ওয়ান টু মেক ফ্রেন্ডশীপ উইথ ওপেন মাইন্ডেড, সমার্ট এন্ড মোষ্ট মডার্ন বয়েজঞ্চ।
মেয়েটি খিল খিল করে হেসে ওঠে। বলে, হাউ ফানি, হাউ ফানি! কে যে এসব লিখে আমার নামেনতার শরীরের চামড়া ছুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
কে লিখেছে আমি জানি।
মেয়েটি কণ্ঠ নরম করে বলে, কে, বলুন তো?
তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দিবেন?
প্রশ্নটা কী?
মাইন্ড করবেন না কিন্তু, একেবারে ব্যক্তিগত প্রশ্ন।
আপনি কিন্তু অনেক ভণিতা করছেন।
সঠিক সঠিক জবাব দিতে হবে।
ও-উ-ফ-স, শুধু শুধু ভণিতা হচ্ছে কিন্তু।
আপনি কি কখনো প্রেম করেছেন?
মেয়েটি শব্দ করে হেসে ওঠে।
শাহিদ আবার জিঞ্চাসা করে, আপনাদের কি প্রেম করে বিয়ে হয়েছে?
মেয়েটি হাসতে হাসতে বলে, আমার মতো একটা কুচকুচে কালো মেয়ের সাথে কে প্রেম করবে, বলুন?
বিশ্বাস করতে পারছি না।
কেন?
একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।
কী রকম?
আপনাদের বিয়েটা কবে হয়েছে?
কী জ্বালা, এতো সব ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর কি দেয়া যায়? আপনার সাথে আমার চেনা নেই জানা নেই, অথচ কতো কিছু জিঞ্চাসা করছেন। আমিও কী বোকা দেখুন, আপনি যা যা জিঞ্চাসা করছেন, আমি তোতা পাখির মতো সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। আর না ভাই, আমি এখন ফোন রাখবো।
ঠিক আছে, রাখুন। তবে আমি কি আবার ফোন করতে পারবোনঅর্থাৎ আমি অনুমতি চাইছি।
ফোন করে কী লাভ, কোন লাভ আছে? আমি একটা বিবাহিতা মেয়ে, বাচ্চা কাচ্চা স্বামী সংসার নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকিননা না না, সম্ভব না। আমি রাখছিনএই রাখলাম।
প্লিজ, আর একঢু~নপ্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।
ওহ্নকী জ্বালায় যে পড়লাম রে বাবা!
আপনার ছেলেমেয়ে কয়টা?
আমার কোন ছেলে নেই, পাঁচটা মেয়ে আছে। হয়েছে?
জ্বি, হয়েছে।
এবার তাহলে গুডবাই।
গুডবাই।
আর শোনেন, আশা করি অন্তত আপনি আর কোনদিন ফোন করবেন না। ব- ফেড আপ হয়ে গেছি।
আমার উপদেশটা মনে রাখবেন কিন্তু।
চেষ্টা করবো। কিন্তু জনাব, আমি ছাড়া যে ফোন ধরার ঘরে আর কেউ নেই।
কেন, আপনার মেয়েরা ধরবে।
ওহ্, ওরাও কি আমার মতো ঝামেলায় পড়বে না? আমি কি পুরুষ মানুষকে চিনি না?
বাসায় কি কাজের লোক বা বুয়া নেই?
হ্যাঁ আছে, কিন্তু এ বাসায় নেই, আমার স্বামীর বাসায় আছে।
ওওওওনএটা তাহলে আপনার বাপের বাড়ি?
জ্বিইইইই----।
কবে এসেছেন?
সপ্তাহ খানেক হলো।
কদ্দিন থাকা হবে?
আর বেশিদিন না, পরশুই চলে যাবো।
আবার কবে আসা হবে?
ঠিক নেই। একমাসও যেতে পারে, দুমাস, ছয়মাসও যেতে পারে।
আপনি খুব নিষ্ঠুর।
হ্যাঁ, আমি খুবই নিষ্ঠুর। আমার স্বামী আমাকে ডাইনি বলে ডাকে।
আপনি প্রতিবাদ করেন না?
এই পুরুষ শাসিত সমাজে কি পুরুষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে টেকা যায়?
আপনার কণ্ঠস্বরটা কিন্তু অদ্ভুত মিষ্টি।
মেয়েটি আবার শব্দ করে হাসতে থাকে। শাহিদ বলে, আপনার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
বাব্বাহ্। দরদ উথলে উঠছে দেখছি? মেয়েটি টিপ্পনি কাটে।
যার বউয়ের এমন মিষ্টি কণ্ঠস্বর, সে কী করে তার বউকে ডাইনি বলে?
আচ্ছা, আমাকে এতো পটিয়ে আপনার লাভ কী?
নাহ্, আমি তো আপনাকে পটাচ্ছি না। যা সত্যি আমি শুধু তাই বলছি। আপনি জানেন না আপনার কণ্ঠে কী আশ্চর্য মাধুর্য আছে।
মেয়েটির মন নরম হয়ে আসে। সে মুগ্ধ ও গাঢ় স্বরে বলে, অথচ জীবনে কতোবারই না কতো অপমান সইতে হয়েছে আমাকে। আপনার মতো কেউই কখনো এমন করে বলেনি।
তাহলে নিশ্চয়ই আমি একটা ধন্যবাদ পেতে পারি! শাহিদ কৌতুক করে বলে।
আপনি জানেন, জীবনে কতোগুলো ছেলেকে আমি পটানোর চেষ্টা করেছি?
মেয়েরা কখনো ছেলেদেরকে পটানোর চেষ্টা করেছে এটা আমি কোথাও শুনিও নি, দেখিও নি। তবে এটা সচরাচর ছেলেদের একটা নিজস্ব পেশা।
মেয়েটি হেসে উঠে বলে, আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।
আপনি ছেলেদেরকে পটাতে পারেন না এ কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। আমি যে সুন্দর করে কথা বলতে পারি আমার জীবনে কোন মেয়ে কোনদিন এ কথা বলেনি। আপনার এই একটা কথায়ই কিন্তু আমি সারাজীবন আপনার কাছে ঋণী থাকবো।
আপনি কখনো প্রেম করেননি?
হ্যাঁ, করেছি।
সেই মেয়েটিও কি কখনো বলেনি?
সে বলবে কেন? আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম। সে তো আর আমার প্রেমে পড়েনি।
ভেরি স্যাড। কিন্তু কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।
আসলে অনেক অবিশ্বাস্য কথা আছে যা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এবং এ থেকেই কিন্তু জ্ঞঅবিশ্বাস্যঞ্চ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে।
ওওওম্মা, আপনি বাংলা ভাষার গবেষক কেউ নন তো?
না হে ভাই, আপাতত আমি একজন মেয়ে-গবেষক।
ওওও, আপনি তাহলে আমার ওপর গবেষণা চালাচ্ছেন বুঝি?
আসলে ঠিক গবেষণা নয়, আমার কী যে ভালো লাগছে আপনাকে বোঝাতে পারছি নানআপনার কণ্ঠস্বরে মনে হয় অমৃত আছে!
আপনাকে আবারো অসংখ্য অসংখ্য অসংখ্যবার ধন্যবাদ। কিন্তু জনাব, আমাকে এখন পটিয়ে কোন লাভ আছে? যখন সময় ছিল তখন কেউ পটাবার ছিল না।
আমি কিন্তু আবারো বলছি, আপনাকে আমি মোটেও পটাচ্ছি না। আপনার সাথে কথা বলতে আমার খুবই ভালো লাগছে, তাই বলছি।
আমাকে কখনো দেখেননি বলে এতো ভালো লাগছে। দেখলে একটা কথাও বলতেন না।
এটাও অবিশ্বাস্য। কোন ছেলে কোন মেয়ের সাথে যে কথা বলতে চায় না তা আমি কখনো শুনিনি।
আপনি বিশ্বাস করছেন না, অথচ আমার জীবনেই এ রকম ঘটনা ঘটেছিল।
কী রকম?
আমাকে দেখাবার জন্য আমার দুলাভাই একবার একটা ছেলেকে নিয়ে এলো। ছেলেটার চেহারা রূপকথার রাজপুত্রকেও হার মানায়। ওকে দেখে আমি পাগল হয়ে গেলাম। আমার পড়ার ঘরে ছেলেটাকে বসিয়ে দিয়ে দুলাভাই চালাকি করে বাইরে চলে গেল। আমি খুব নার্ভাস হয়ে উঠতে থাকলাম। কিন্তু ছেলেটা অত্যন্ত শুকনো মুখে আমার নাম কী, কোন্ ক্লাসে পড়ি, রাঁধতে জানি কিনা তা জিঞ্চাসা করে বেরসিকের মতো উঠে বাইরে গিয়ে সিগারেট টানতে লাগলো।
তারপর?
জানালা দিয়ে আমি ছেলেটার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েরা ছেলেদের সিগারেট খাওয়া একদম চোখে দেখতে পারে না। কিন্তু ওর সিগারেট খাওয়ার ভঙ্গি আর সমার্টনেস দেখে ডলি সায়ন্তনীর গানটার কথা মনে পড়ে যায়। আমি মনে মনে গাইতে থাকি জ্ঞহে যুবক...ঞ্চ। বার কয়েক ছেলেটার সাথে চোখাচোখি হলো। কিন্তু ওর চোখেমুখে কোন আবেগ নেই, উচ্ছ্বাস নেই। বলুন তো ছেলেরা এমন হয় কেন?
ছেলেটার কথা শুনে তার প্রতি আমার প্রচণ্ড ঈর্ষা হচ্ছে।
তারপর শুনুন না কী হলো। ও একটা বড় এনজিওতে চাকরি করতো। একদিন ওর অফিসে ফোন করলাম। হ্যালো বলে ও আমার পরিচয় জানতে চাইল। নার্ভাস অবস্থায় আমার পরিচয় দিলাম। কিন্তু আমাকে সে চিনতেই পারলো না। আমি কি বলতে পারি যে কিছুদিন আগে আপনি আমাকে দেখতে এসেছিলেন? হঠাৎ আমার দুলাভাইয়ের নাম বলি। বলি, আপনি অমুকের সাথে আরেকবার বেড়াতে আসুন না। এবার মনে হলো সে অতি কষ্টে চিনতে পারলো। কিংবা এতোক্ষণ চিনেও না চেনার ভান করে থাকতে পারে। তারপর বলে কী, শোন, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি। কোন জরুরি কিছু কি বলার আছে? না থাকলে এখন রাখি, কেমন? বলেই আমাকে জবাব দেবার সুযোগ না দিয়েই ধপ করে রিসিভার নামিয়ে রাখে।
আসলে যারা পাষণ্ড তারাই মেয়েদেরকে বেশি আকৃষ্ট করে।
এ কথা বললেন কেন?
জানেন না, চুম্বকের সমমেরুতে বিকর্ষণ, বিপরীত মেরুতে আকর্ষণ? আপনি যদি ছেলেটার প্রতি এতো আগ্রহ না দেখাতেন তাহলে দেখতেন উল্টো সে-ই আপনার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তো।
আমি আসলে এসব বুঝি না। আমি খুবই একটা বোকা মেয়ে। তাই আরো একদিন বেহায়ার মতো ফোন করলাম, ওদের বাসায়। ভয়ে ভয়ে ছিলাম কে না কে আবার ফোন ধরে। দেখি, না, সেই ধরলো। এবার কোন ভণিতা না। আমাকে প্রথমেই চিনতে পারলো। কিন্তু জ্ঞএকটু ধরোঞ্চ বলে করলো কী, আমাকে লাইনে রেখে সে পাক্কা দশ মিনিট বাথরুমে কাটিয়ে এলো। তারপর বলে, আমাকে জরুরি কাজে একটু বের হতে হচ্ছে। পরে ফোন করবো, কেমন?
পরে করেনি ফোন?
আপনি পাগল হয়েছেন? সে মনে করেছিল তার গলায় ঝুলে পড়বার জন্যই আমি উঠে-পড়ে লেগেছিলাম। আগে আমার এই জিনিসটা মাথায় ঢোকেনি। যখন ঢুকলো তখন এতো খারাপ লেগেছিল নিজের ওপর, কী বলবো?
আপনার জন্য আমার অশেষ সহানুভূতি রইল।
দেখুন, আমি কতো বোকার বোকা। আপনার সাথে আমার কোন পূর্ব পরিচয় নেই অথচ ভরভর করে আমার ব্যক্তিগত কতো কথা বলে ফেললাম। আচ্ছা, আপনি কী করেন?
ম্যাডাম, মনে যদি ব্যথা না নেন, আমার পেশাটা আমি সব সময়ই উহ্য রাখি। আমি বিশ্বাস করি যে পেশা নয়, মানুষ হিসাবে আমি কতোখানি মানুষ সেটাই আমার বড় পরিচয়। তবে কথা দিলাম, আপনার কাছে একদিন সত্য প্রকাশ করবো। কিন্তু আজ এ প্রশ্নটার উত্তর দিতে চাচ্ছি না।
আচ্ছা, ঠিক আছে, এতো বড় লেকচারের দরকার কী? আজ কেন, আর কক্ষণোই দিতে হবে না। রাখি, খোদা হাফেজ।
প্লিজনআর একটা প্রশ্ন।
আর একটা প্রশ্নও না। আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। আপনি কিন্তু আমার একটা মাত্র প্রশ্নেরই জবাব দিতে চাননি।
স্যরি, আমার ঘাট হয়েছে। আসলে আমি বেকার তো, তাই এ কথা বলতে লজ্জা হয়।
বেকার কেন, চাকরি ধরেন?
কোথায় চাকরি পাবো? দেশে কি চাকরি আছে?
তাহলে বিদেশে যান।
বিদেশে যেতে টাকা লাগে না? আমার তো ভাতই জোটে না।
কিন্তু এদিকে যে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করে দেধারছে মেয়ে মানুষের সাথে চ্যাট করে যাচ্ছেন, আর টাকা উড়াচ্ছেন?
আমি কিন্তু খুব একটা চ্যাট করি না।
যে লোক ইন্টারনেটে এতো পাকা সে লোক চ্যাট করে না, আপনি বলবেন আর আমি তা বিশ্বাস করবো?
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, যেটা সত্যি আমি সেটাই বলেছি।
আচ্ছা, আপনার বয়স কতো?
৫৫ বছর।
মিথ্যে কথা।
মিথ্যে কেন?
আপনার বয়স পঁচিশের ওপর হতেই পারে না।
কীভাবে বুঝলেন?
বুঝলাম আপনার কণ্ঠস্বর শুনে।
আমার চেহারা দেখেও কিন্তু অনেকে এ কথা বলেন।
কী বলেন?
যেমন, আমার ছোট নাতিকে নিয়ে যখন স্কুলে যাই তখন সবাই মনে করে যে ওটা আমার ছেলে। লজ্জার কথা না, বলুন? হাসছেন যেন্সাংঘাতিক মেয়ে তো আপনি, হেসে খুন হচ্ছেন, আমি কি হাসির কিছু বলেছি?
আপনি খুব রসিক মানুষ।
আপনিও খুব মিষ্টি মেয়ে।
এটা আপনার ব- চাপা মারা হলো। আমি দেখতে মোটেও মিষ্টি নই।
কিন্তু আপনি যতো যা-ই বলুন না কেন, আপনার কণ্ঠস্বরটা কিন্তু অপূর্ব। জন্মের সময় আপনার মুখে এক ড্রাম মধু ঢালা হয়েছিল।
মেয়েটি খিল খিল করে হাসতে থাকে। শাহিদ বলে, আপনি খুব হাসেন।
কিন্তু আপনি মোটেও হাসেন না। আপনি কি গোমড়ামুখো?
খুউব।
মেয়েটি আবার হাসতে থাকে। তারপর বলে, আচ্ছা, আপনি এতো কম হাসেন কেন?
জানি না। আপনি খুবই চঞ্চল, তাই না?
কিন্তু কীভাবে বুঝলেন?
আপনার শরীরটাও হালকা পাতলা, ঠিক বলেছি?
কী আশ্চর্য, এসব বুঝলেন কীভাবে?
যারা চঞ্চল তারা খুব হাসে।
আপনি কি দেখতে খুব ভারি?
কেন?
যারা দেখতে ভারি, তারা খুবই কম হাসে।
ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমার শরীর মোটেও ভারি নয়।
আচ্ছা, আপনি বিয়ে করেছেন কবে? হাসি থামিয়ে মেয়েটা জিঞ্চাসা করে।
বলবো কেন?
এমনিই।
আপনি?
অনেক আগে।
বলা যায় না?
সেই অনেক অনেক দিন আগের কথা। বলেই মেয়েটি খিল খিল করে হেসে ওঠে।
আপনার হাসিটা আমাকে পাগল করে দেয়। শাহিদ হাসতে হাসতে বলে।
তাই? তাহলে তো আপনাকে অতি সত্বর পাবনা যেতে হবে।
কেন?
আরো জোরে হেসে দিয়ে সে বলে, ওওওম্মা, তাও জানেন না?
আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
কেন?
আহা, একটা মেয়ের সাথে ফ্রেন্ডশীপ হচ্ছে, আর তাকে দেখবো না?
কে বলেছে আপনার সাথে আমার ফ্রেন্ডশীপ হচ্ছে?
কেন, হলে অসুবিধা আছে?
আপনার বউ জেনে ফেললে খবর আছে, দ্যা নিউজ এ্যাট টেন।
মোটেও না।
আপনার বউ আপনাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবেন?
অবশ্যই। আমি তো কোন অপরাধ করছি না।
মোটেও না! একটা পরস্ত্রীর সাথে আপনি চুটিয়ে কথা বলবেন আর আপনার স্ত্রী তা শুনে মজা পাবেন, এটা কেউ বিশ্বাস করবে?
বিশ্বাস না করার কী আছে? আমার বউয়ের এতোগুলো বয়ফ্রেন্ড আছে, সেজন্য আমি কি তাকে খেয়ে ফেলছি?
আপনার বউয়ের বয়ফ্রেন্ডও আছে?
অবাক হবার কী আছে? পুরুষ মানুযের যদি গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে, মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড থাকবে না কেন?
কিন্তু আমাদের দেশে মেয়েদের, বিশেষত বিবাহিতা মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড থাকার কালচারটা আন-ইউজুয়াল।
কিন্তু আমাদের পরিবারে এটা খবুই ইউজুয়াল ব্যাপার স্যাপার।
আচ্ছা, আপনার ছেলেমেয়ে কজন?
আপনার?
ওহ্, কী যে জ্বালা! আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো আমাকেই সেই প্রশ্নটা ফেরত দিচ্ছেন। নাহ্, আর না, অনেক কথা হয়েছে। এই রাখলাম। খোদা হাফেজ। বাইনগুডবাই।
সত্যিই খুব নিষ্ঠুর আপনি।
নিষ্ঠুর কি আপনিও নন?
অবশ্যই নই।
এ কথা আপনার মুখে সাজে না। এ পর্যন্ত আপনার সম্পর্কে যা যা জানতে চেয়েছি আপনি তার কিছুই বলেননি।
এটা ঠিক বলেননি।
মানে?
প্রথমত আপনি আমার সম্পর্কে কিছুই জানতে চাননি।
ওহ্, এতো মিথ্যেও বলতে পারেন?
দ্বিতীয়ত, আমার সম্পর্কে আপনার কিছু জেনেই বা লাভ কী?
ও-কে, কোন লাভ নেই, স্যরি, আপনাকে প্রশ্ন করাটা আমার মস্ত ভুল হয়েছে। যেহেতু কোন লাভ নেই তাহলে আর কোন কথা বলারও দরকার নেই। রাখলাম। গুডবাই ফর এভার।
খট করে রিসিভার রেখে দেয়ার শব্দ হয়। শাহিদের বুকের ভিতরে প্রচণ্ড একটা চোট লাগে, তার অন্তর জ্বলতে থাকে। আরেকবার ফোন করলে কেমন হয়? শাহিদ ভাবে। মেয়েটি শেষের দিকে এসে বেশ বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় আর কোন ফোন করা যায় নানএতোক্ষণ তো যা হোক ভালোয় ভালোয় টকঝাল মিষ্টি কথা বলা হয়েছে, ঠা-া রসিকতা হয়েছে, গালি গালাজ যে করে বসেনি সেটাই সবচেয়ে সুখকর ও উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। এটা একটা উপভোগ্য পুরস্কারও বটে।
আরেকবার ফোন করবে কী করবে না এ নিয়ে শাহিদের মনের মধ্যে প্রচুর দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলতে থাকলো। এমনও হতে পারে যে মেয়েটি নিশ্চিত ধরে নিয়েছে শাহিদ পুনরায় ফোন করবেই, কাজেই সে গালে হাত দিয়ে অধীর আগ্রহে এখন ফোনের পাশে বসে আছে।
শাহিদ রিসিভার উঠিয়ে কানের কাছে ধরে, ডান হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে ডায়ালিং ডিজিটের ওপর হাত রাখে, তারপর একে একে টিপে ৭, ৪, ১,৭, ০, ৯, ৯। রিং বাজবার অপেক্ষা করতে থাকে আর ঢিভ ঢিভ করে তার বুক কাঁপতে থাকেনমেয়েটির কণ্ঠস্বর তার প্রাণের ভিতরে গেঁথে গেছে, শাহিদের আশংকা, এই কণ্ঠ যদি ঝাঁঝালো তিক্ত স্বরে ভর্ৎসনা করে বলে বসেনআপনি একটা নির্লজ্জ! আবার ফোন করেছেন কেন?
কিন্তু শাহিদের মনে আবার সাহসও জাগে, এ মেয়ে নিশ্চয়ই এতোখানি যাবে না, বেজায় ভদ্র, শিষ্ট ও মিষ্টভাষিণী সে, তারও নিশ্চয়ই শাহিদের কথাগুলো শুনতে ভালোই লেগেছে, তা না হলে প্রথমবার অপরিচিত কণ্ঠস্বর পেয়েই সে খুট করে রিসিভার নামিয়ে রাখতো।
পি-প-স পি-প-স পি-প-স।
শাহিদ হাফ ছেড়ে বাঁচে, লাইন ক্লিয়ার পাওয়া যায়নি। তার বুক এখনো কাঁপছে, আবেগ ও শংকিত অস্থিরতায়।
রিসিভার নামিয়ে রেখে সে লম্বা দম ছাড়ে, বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে ওপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফ্যানটি ঘুরছে লো স্পীডে, বিকালে বৃষ্টি হয়ে গেছে বলে এমনিতেই ঘরটা ঠাণ্ডা। অথচ গতকাল সন্ধ্যায় এমন সময়ে গরমে ছটফট করছিল সে, ফুল স্পীডে ফ্যান ছাড়লে কী হবে, মনে হচ্ছিল ফ্যানের সেন্টার থেকে গরমের পিন্ড ফ্যানের সাথে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
সুন্দর একটা ভালোলাগা শাহিদের সারা মন প্রাণ জুড়ে। এমন একটা চমৎকার মেয়ের সাথে সারাজীবন টেলিফোনে কথা বলে কাটিয়ে দেয়া যায়। মেয়েটি যখন ঝাঁঝালো স্বরে রেগে কথা বলেছে তা শুনতেই ওর সবচাইতে বেশি ভালো লেগেছে। যৌবন এমনই, মেয়েদের রাগ দেখলে অনুরাগ শতগুণ বেড়ে যায়।
যুগপৎ শাহিদের মনটা ছটফট করতে থাকলো। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় মেয়েটির নাম জানা হয়নি। ইন্টারনেটে অবশ্য নাম লেখা ছিল তিশা। ওটা ছদ্মনাম না আসল নাম তা বোঝার উপায় নেই।
ইন্টারনেটে অবশ্য আসল নাম খুব কমই ব্যবহার করা হয়। অতএব তিশা তার ছদ্মনামই হবে। তবে এটা যদি সত্যি সত্যিই কোন জ্ঞসত্যিঞ্চ নাম হয়ে থাকে তবুও এই মেয়েটির নামই যে তিশা সে ব্যাপারেও কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যায় না। তিশা এর বড় বোন বা ছোটবোনও হতে পারে, হতে পারে চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো বোন বা বান্ধবী।
শাহিদের ভুল ভাঙ্গে, এই মেয়েটিই তিশা। কেননা তিশা বলেছে সে নিজে ইন্টারনেটে তার নাম ঢোকায়নি, অন্য কেউ যড়যন্ত্র করে তা করেছে।
আবার রিসিভার তুলে আয়েস করে ডায়াল করতে থাকে শাহিদ, এখন মনের দ্বিধা ও জড়তা অনেক কেটে গেছে। সে ভাবে, মেয়েটি ধমকে উঠলে উঠবে, সে আমাকে খারাপ ভাবলে ভাবুক, আরেকবার আরেকটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে দোষ কোথায়?
ইয়েস, লাইন ক্লিয়ার পাওয়া গেছে, রিং যাচ্ছে, রিং যাচ্ছেনক্রিংক্রিংনক্রিংক্রিংন ক্রিংক্রিংক্রিংনকিন্তু কেউ রিসিভার তুলছে না, রিং বাজছে অনবরতনক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিংক্রিং।
তিশা কি এখন বাড়িতে একা? সে নিশ্চয়ই বাথরুমে ঢুকেছে, ফোন বাজার শব্দ শুনে ছুটে বেরিয়ে আসতে দেরি হচ্ছে। অথবা সে রান্না ঘরে আছে, অতোদূর টেলিফোনের আওয়াজ গিয়ে পৌঁছে না। রান্নাঘরটা কি এতোই দূরে? হয়তো হাতের রান্নাটা ছেড়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না, ওগুলো গুছিয়েই সে টেলিফোনের দিকে দৌড়ে আসছে।
এতোক্ষণ পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু ১২টা রিং বাজার পর লাইন কেটে যায়।
বাড়িতে কি চাকর-বাকর কাজের ছেলে-মেয়ে কেউ নেই? কিংবা অন্য কেউ? তিশা বাড়িতে একা কী করে থাকে? কী করে সে? এখন কী করছে? ছাদে যায়নি তো? মেয়েরা সন্ধ্যার পরে ছাদে খুব একটা যায় না, যারা যায় তারা বেশির ভাগই বিবাহিতা। অবিবাহিতা মেয়েদের জন্য বিকেলে ছাদে ঘুরে বেড়ানোটা সবচাইতে প্রিয়নকারণ, নিচে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নিরাপদ পথ কিংবা পার্ক নেই, অথচ ওরা চায় তরুণেরা ওদেরকে দেখুক এবং ওরাও তরুণদেরকে দেখুক।
শাহিদ আবারো রিং করে।
রিং যাচ্ছে। ক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিংন্দুবার রিং বাজার পরই রিসিভার তুলে অতিশয় তীক্ষ্ণ ও রুক্ষ স্বরে কে এক মহিলা চেঁচিয়ে বলে উঠলো, হ্যালোনহ্যালোন।
শাহিদ একটা ঢোক গিলে, তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার মতো হয়, ভয়ে ও শংকায়। মহিলা আবার বলেনহ্যালো------। শাহিদ আরেকবার ঢোক গিলে বলে, এটা কি মুন্নাদের বাসা?
জ্বি না, রং নাম্বার। বলে দরাস করে রিসিভার রাখে মহিলা। শাহিদের গলা শুকিয়ে গেছে। সে কয়েকবার ঢোক গিলে গলা ভিজায়।
কোথায় গেল তিশা? মাত্র পাঁচ দশ মিনিটের ব্যবধানে সে হাওয়া? নাকি শাহিদের দেয়া উপদেশ সে কাজে লাগাচ্ছেনসে নিজে ফোন না ধরে পাঠাচ্ছে অন্য কাউকে। তাহলে তো মহা মুশকিল, নিজের হাতে নিজের ভাগ্যকে মুছে ফেললো সে। এই দুঃখের কথা কি কাউকে বলা যায়?
এমনও তো হতে পারে যে তিশা সত্যি সত্যিই বাইরে চলে গেছে। যে ফোন ধরেছিল সে হলো কাজের বুয়া। বুয়াদের গলার স্বর এমন খরখরেই হয়।
শাহিদের বুকে অতৃপ্তির আগুন জ্বলতে লাগলো। আরেকবার ফোন করলে কেমন হয়? হয়তো তিশা ছাদেও যায়নি, বাইরেও যায়নি, অন্য কোন কাজে ঘরেই সে ব্যস্ত ছিল। থাকে না? মেয়েদের কতো রকমের গোপন ব্যস্ততা থাকে। সন্ধ্যার পরপরই একটু সাজগোজ করা, যারা বিকেলে বেরোয় না তারা এটা এ সময়েই করেন্সন্ধ্যার পরপর আশেপাশের বাসা থেকে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য কেউ আসতে পারেন, তাঁদের সামনে ঘরের গাউন পরে তো আর উপস্থিত হওয়া যায় না। কারো কারো স্বামী সন্ধ্যার পর দিয়ে ঘরে ফিরেন। স্বামীর জন্য সেজেগুঁজে থাকতে হয়। সারাদিন ভীষণ কর্মব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে স্ত্রীর নোংরা বসন-ভূষণ দেখলে কি কোন পুরুষের মেজাজ ঠিক থাকে? ও-সময় স্ত্রীর রমণীয় কমনীয় আর আকর্ষণীয় মুখটি দেখতে পেলে স্বামী বেচারা আমোদে চাঙ্গা হয়ে উঠবেন।
তিশার স্বামীর কথাটা আর মাথায় আনতে চায় না শাহিদ, এটা একটা অবান্তর ভাবনা। ইন্টারনেটে তিশার পার্সোনাল ইনফরমেশন বক্সে ম্যারিটাল স্ট্যাটাসের বিপরীতে পরিষ্কার লেখা ছিলনআনম্যারিড। যদিও বন্ধুত্ব করার কথাই লেখা ছিল কিন্তু শাহিদ জানে শুধু শুধু বন্ধুত্বের জন্য কেউ ইন্টারনেটে ওভাবে নাম ছড়ায় না। তার আড়ালে একটা বিশাল ও মহৎ এবং ~েবষয়িক উদ্দেশ্য লুকানো থাকেনপ্রথমে বন্ধুত্ব, টেলিফোনে আলাপনঘন্টার পর ঘন্টা, ডেটিংনঘন ঘন ডেটিং, শেষ পর্যন্ত সেই মহৎ উদ্দেশ্যটির বাস্তবায়ননবিয়ে-সংঘটন।
অতএব, যতো ঝাড়িঝুড়িই ঝাড়ুক না, তিশা নিঃসন্দেহে একটা অবিবাহিতা মেয়ে। সে যে একটা পাকা শিকারি সে কথাটাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বড়শিতে আধার গেঁথে বারবার মাছের সামনে থেকে সে বড়শি তুলে নিচ্ছে, আধারের লোভে মাছ বড়শিতে ঠোকর দিবেই।


পর্ব-২

পরের দিন একই সময়ে শাহিদকে আবারো টেলিফোনের নেশায় পেয়ে বসলো। আসলে তার এই নেশা তো গতকাল থেকেই। প্রথমবার টেলিফোন করার পর থেকেই সে খুব অস্থির সময় কাটাচ্ছে।
বুকের ভিতর কাঁপন নিয়ে শাহিদ ডায়াল করলো।
রিং যায়নক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিং।
চারবার রিং বাজলো। তারপরন হ্যালো স্লামালাইকুমনতিশার মধুঝরা কণ্ঠস্বর মোলায়েমভাবে ভেসে আসে। শাহিদের সারা শরীর জুড়ে ঢেউ খেলে যায়। সে কিছু বলতে পারে না।
হ্যালো----তিশা আবার ডাকতেই শাহিদ সম্বিৎ ফিরে পায়।
হ্যালো স্লামালাইকুম। ভালো আছেন? শাহিদ নরম স্বরে জড়তাগ্রস্তভাবে জিঞ্চাসা করে।
হ্যাঁনতিশা একটু লম্বা করে উত্তর দেয়।
আপনি বোধ হয় আমার ওপর রেগে আছেন, তাই না? শাহিদ জিঞ্চাসা করে।
শুনুন ভাই, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি। সামনে জুলাইয়ে আমার মাস্টার্স ফার্স্ট পার্ট পরীক্ষা তো, প্রচুর পড়া বাকি। ফোনে প্রেমালাপ করার মতো আমার এখন যথেষ্ট ~েধর্য্য আর সময় নেই।
স্যরি, আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম।
এখন রাখি তাহলে, ঠিক আছে?
প্লিজ প্লিজ, আর একটা মিনিট মাত্র, রাখবেন না প্লিজ।
ওওওহ্, বলুন। তিশার কণ্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়ে।
আপনি কোন্ সাবজেক্ট পড়ছেন?
তিশা রেগে ওঠে। বলে, দেখুন ভাই, আমি এ পর্যন্ত আপনার সাথে প্রচুর ভদ্র ব্যবহার করেছি, আপনি যেসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিঞ্চাসা করছেন এগুলো জানার কি আপনার কোন দরকার আছে? আমিই বা বলবো কেন? এসব জেনে কী করবেন আপনি? আমি আগেই আপনাকে বলেছি যে ইন্টারনেটে যা দেখেছেন ওগুলো সব ভুয়া, আমি দিইনি। একটা ছেলে আমাকে খুব ভালোবাসতো, ঐ যে বলেছিলাম না রূপকথার রাজপুত্রের কথা, সেই রাজপুত্রই পরে আমার প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ও ছিল একটা মদখোর, ওর আরেকটা বউ ছিল, সেই বউকে ভালো লাগেনি বলে তালাক দিয়েছিল, তারপর আমার পেছনে লেগেছিল। আমি অমন একটা নষ্ট পুরুষের বউ হতে যাবো কোন্ দুঃখে? আমার কি আর বর জুটবে না? যাই হোক, সেই কুলাঙ্গার ছেলেটাই এখন আমার নামে আজেবাজে কথা চারদিকে ছড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেটে আমার ঠিকানা আর ফোন নম্বর ঢুকিয়ে দিয়ে আমার জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলছে।
আপনি ছেলেটার নামে কেইস করছেন না কেন?
কেইস করে কি আমি চারদিকে রটিয়ে দিব যে বিয়ের আগে আমি রসিয়ে রসিয়ে চুটিয়ে চুটিয়ে ঐ বদমাশটার সাথে প্রেম করেছি? আমাকে তো স্বামীর ভাত খেতে হবে, নাকি?
আপনার স্বামী কী করেন?
কিচ্ছু করে না।
আচ্ছা, না বলবেন না বলুন।
আপনার এক মিনিট সময় কিন্তু শেষ। রাখি।
প্লিজ, আরেকটা প্রশ্ন।
ও-কে, শেষ প্রশ্ন। এটার উত্তর দিয়েই আমি রেখে দিব। তারপর আর একটা কথাও শুনবো না।
আমি মেনে নিলাম।
প্রশ্নটা কী?
আপনার নামটা কি জানতে পারি?
আমার নাম দিয়ে কী করবেন?
পরস্পর কথা বলতে কি সম্বোধনের প্রয়োজন পড়ে না?
এতোক্ষণ ধরে কতো কথা বললেন, এতে কি কোন সমস্যা হয়েছে?
তারপরও, এই যে এতো কথা বললাম কিন্তু নামটাই জানা হলো না, তাতে কি পরিচয়টা ফাঁকা রয়ে গেল না?
আমি তো আপনার নাম জানতে চাইনি।
চান না কেন? আমাকে আমার নাম জিঞ্চাসা করুন।
আপনার নাম কী?
আমার নাম বাটপার।
তিশা প্রচণ্ড শব্দ করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে, আপনি অকপটে অনর্গল মিথ্যে বলতে পারেন তা আমি গতকালই বুঝতে পেরেছিলাম।
কীভাবে?
কীভাবে? আপনি বলেছেন আপনার বয়স ৫৫। অথচ আপনার কণ্ঠস্বর শুনে আপনাকে ১৫ বছরের বালক মনে হয়। বলেই সে আরো জোরে শব্দ করে হাসতে থাকে।
শাহিদ বলে, এটা আপনার ভুল ধারণা। আমি ১২ বছরের কিশোরকে দেখেছি ৬০ বছরের বুড়োদের গলায় কথা বলে, আবার ৬০ বছরের বুড়োকে দেখেছি ১০ বছরের বাচ্চার মতো চিকন স্বরে মিনমিন করে কথা বলতে।
ও-প্রান্তে তিশা অনবরত হেসেই চলছে। সে বলে, কতো অবলীলায় আপনি বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলে যাচ্ছেন, আমি কেবলই ভাবছি আর অবাক হচ্ছি।
ম্যাডাম, আপনি কি কম গেছেন?
ওওও, তাহলে স্বীকার করছেন যে এতোক্ষণ আপনি মিথ্যে বলেছেন?
স্বীকার করছি। তবে খুব বেশি বোধ হয় বলিনি, মাত্র একটা কি দুটো।
কেন মিথ্যে বলেছেন?
যে কারণে আপনি বলেছেন।
আমি কোন মিথ্যে বলিনি।
এটাও একটা ডাহা মিথ্যে।
হোয়াট? আপনার স্পর্ধা কিন্তু মিস্টার বেড়েই চলছে। মুখের ওপর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছেন।
স্যরি, ঘাট হয়েছে।
ওহ্, আপনার এই জ্ঞঘাটঞ্চ শব্দটা আমার আরো অসহ্য লাগে। পুরুষ মানুষের মুখে মেয়েলি কথা। শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।
আই এ্যাম এক্সট্রেমলি স্যরি মাই ডিয়ার ম্যাডাম।
আই উড বি এক্সট্রেমলি হ্যাপি ইফ ইউ কুড টেল মি ইয়োর নেইম।
আই এ্যাম রনি।
সিওর?
সিওর।
কাল জিঞ্চাসা করলে আবার জনি বলবেন না তো?
সেটা কালই দেখা যাবে।
দেখা যাবে।
কাল কি ঠিক এই সময়ই------?
ও গড----তিশা প্রায় চিৎকার করে বলে ওঠে, আই উইথড্রো মাই ওয়াড্র্স, নো মোর টেলিফোন, নো মোর টক্স। লেট ইট বি দ্য লাস্ট চ্যাট।
ইউ আর সো হার্শ্!
হ্যাঁ, আমি খুবই কঠিন একটা মেয়ে।
মানুষকে এভাবে আঘাত দিয়ে আপনি কী মজা পান?
আমি কাউকে কখনো আঘাত দিই না। কেউ যদি মনে করে যে আমি তাকে আঘাত দিয়েছি তাহলে আমার কিছু করার নেই।
ওহ্, কী হৃদয়হীনা এক মেয়ে যে আপনি! আপনার স্বামী নিশ্চয়ই সব সময় আপনার ভয়ে তটস্থ থাকে। তাই না?
ভয়ে তটস্থ থাকবে কেন?
না, এমনিই বলছি, যে রাগ আপনার মধ্যে!
সত্যিই আমার খুব রাগ। রাগলে আমি মাটিতে পা আছড়ে কাঁদতে থাকি। সেই ছেলেবেলা থেকেই, এখনো তা রয়ে গেছে। বাড়ির চৌদ্দ গুষ্টি মিলে আমার ভজন না করলে আমার সেই রাগ থামে না।
আচ্ছা তিশা----
হোয়াট?
স্যরি, অনুমতি না নিয়েই আপনার নামটা উচ্চারণ করে ফেললাম।
তিশা হেসে ওঠে। তারপর বলে, কারো নাম উচ্চারণ করতে যে অনুমতির প্রয়োজন পড়ে জীবনে এই প্রথম শুনলাম।
তাহলে অনুমতি পেয়েছি বলেই ধরে নিতে পারি। তাই নয় কি?
কিন্তু ওটা আমার নাম না।
তাহলে?
ওটা কারো নামই না। আমাদের চৌদ্দ গুষ্টিতে কারো নাম তিশা ছিল না।
আশ্চর্য।
আশ্চর্য কেন?
নাম লেখা ভিন্ন মেয়ের, অথচ ফোন নম্বর আপনার। আশ্চর্য না?
এটা বুঝতে পারলেন না?
ধরতে পারছি না, মাথায়ই ঢুকছে না।
না পারলে না পারুন। ওওওফ, কথা বলতে বলতে টায়ার্ড হয়ে গেছি।
আপনার নামটি বলুন না প্লিজ।
আমার নাম মিমি। হয়েছে? খুশি হয়েছেন?
কী যে খুশি হয়েছি তা বোঝাতে পারবো না।
আমাকে বোঝাতে হবে না।
আপনি বড় নিষ্ঠুর।
এ নিয়ে কম করে হলেও পাঁচবার বলেছেন।
আপনি এতো নিষ্ঠুর কেন বলুন তো?
আমি জানি না এতো কিছু।
অথচ আপনি জানেন না, আপনার প্রথম দিনের সেই কণ্ঠস্বর এখনো আমার কানে অবিরাম বাজে। গতকাল সারারাত সারা স্বপ্ন জুড়ে শুধু দেখেছি আমি আপনার সাথে কথা বলছি। ঘুম ভেঙ্গে গেলে তখনো শুনি আমার কানের কাছে আপনার কণ্ঠস্বর মধুর ধ্বনির মতো বাজছে।
ফোনে মিমির চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসে। সে বলে, আপনি কে বলুন তো? আপনি কি একজন কবি?
আমি যদি কবি হতাম খাতার পাতা ভরে ফেলতাম আপনার নামে কবিতা লিখে। কিন্তু আমি লিখতে পারি না।
এখন শুরু করুন।
কার জন্য লিখবো? কাকে নিয়ে লিখবো?
আপনার প্রেমিকাকে নিয়ে লিখুন।
আমার প্রেমিকা কি আমার কবিতা শুনবে? সে এক হৃদয়হীনা নারী।
এএএ----ইই, মিমি ধমকে উঠে বলে, আজেবাজে বকবেন না কিন্তু।
স্যরি।
আপনি কি প্রেম করেছেন কখনো?
হ্যাঁ----
কটা করেছেন?
মাত্র একটা।
সেটা কার সাথে, আপনার স্ত্রীর সাথে?
নো ম্যাডাম, আমার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে তার স্বামীর সাথে।
মিমি সশব্দে হেসে ওঠে। বলে, যা অদ্ভুত অদ্ভুত কথা না আপনি বলেন!
আপনার কথা দিনভর শুনতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, আপনি কবিতা ভালোবাসেন না?
ওওউ, সবচাইতে দুর্বোধ্য একটা বিষয়।
কিন্তু কবিতাই পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট বিনোদন, মানেন? দুঃখে কবিতা, সুখে কবিতা, সংগ্রামে, বিজয়ে সর্বত্রই কবিতা। পুরো জীবন জুড়েই কবিতা, জীবনটাই কবিতা।
আপনি খুব সাংঘাতিক হাই সাউন্ডিং এ্যাবস্ট্রাক্ট কথা বলছেন। এসব তত্ত্ব আমার মাথায় ঢোকে না।
আপনাকে ছোট দু-লাইনের একটা কবিতা শোনাই?
আমাকে শোনাবার যেহেতু এতোই শখ, তাহলে শোনান।
থাক, শোনাবো না।
বাব্বাহ্, অভিমানও আছে দেখছি। স্ত্রীর সাথে অভিমান করেন না?
হ্যাঁ করি।
আপনার কবিতার লাইন দুটো শুনি?
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে একদিন বরুনা বলেছিল, যেদিন তুমি আমায় সত্যিকারে ভালোবাসবে সেদিন আমারও বুক হতে এমনি আতরের গন্ধ বেরুবে।
সামান্য নীরবতা। তারপর শাহিদ জিঞ্চাসা করে, অর্থটা বুঝতে পেরেছেন?
পারবো না কেন? ছ্যাকা খাওয়া কবিতা, কঠিন ছ্যাকা খেয়েছেন তা বোঝাই যায়।
বলুন তো কার লেখা?
একটা বোকাও বলে দিতে পারবে এটা কার লেখা।
কিন্তু আপনি খুব বুদ্ধিমতি, আপনার জন্য একটা কুইজ, আপনি বলুন এটা কার লেখা।
আপনি লিখেছেন! আপনি ছাড়া কি অন্য কেউ এরূপ জ্বালাধরা কবিতা লিখবে?
শাহিদ হাসে।
মিমি বলে, আমাকে যতোটা বোকা ভাবছেন আমি ততোটা বোকা নই, তার চেয়ে একটু বেশি বুদ্ধিমতি।
আচ্ছা বেশ, একটা কথার জবাব দিন। রাতে ফোন করলে কি মাইন্ড করবেন?
খবরদার খবরদার, ও-কাজ কক্ষণো করবেন না।
কেন?
এগারোটার পরপরই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের সময় কেউ ফোন করলে তাকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
তাহলে কাল এ সময়?
না ভাই, আপনি একজন বিবাহিত পুরুষ হয়ে খামোখা কেন আমাকে বিরক্ত করবেন?
তাহলে পরদিন?
না, তাও না। আচ্ছা, আপনি কি জানেন আমাদের কতোক্ষণ ধরে কথা হচ্ছে?
হ্যাঁ জানি, প্রায় ৪০ মিনিট।
এভাবে কথা বললে তো আপনি ফতুর হয়ে যাবেন।
আপনার জন্য আমি ভিখারি হতেও প্রস্তুত।
মিমি হাসে। বলে, একদম হাবুডুবু খাচ্ছেন দেখি!
আপনার কি একটুও মায়া হয় না?
আমার কোন দয়ামায়া নেই।
কী নিষ্ঠুরই না আপনি!
ওওউউফ, আবার সেই একই শব্দ। কানে জ্বালা ধরে গেল এই একই কথা শুনতে শুনতে। নাহ্, এই শুনুন, এখন আমার হাজব্যান্ড বাসায় ফিরবে, এসে যদি এই পরকীয়া দেখে তাহলে আজই আমাকে ঝাড়ু মেরে ঘরের বার করে দেবে।
আমার ওপর আপনার ভরসা নেই?
দেখুন, আমরা লিমিট ক্রস করে যাচ্ছি।
স্যরি।
এখন রাখতেই হচ্ছে। স্যরি, মাইন্ড করবেন না, রেখে দিচ্ছি। খোদা হাফেজ।
শাহিদ খোদা হাফেজ বলার আগেই রিসিভার রেখে দিল মিমি। একটা প্রচণ্ড ভালো লাগা দোলা দিয়ে যায় তার মনে, আবার অতৃপ্তির জ্বালাও তেমনি আগুন জ্বালতে লাগলো।


পরদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টিহীন প্রবল ঝড় হলো। ঝড়ের তান্ডবে অনেক ডালপালা ভেঙ্গে ছুটে এসে জানালায় লাগলো, জানালার একটা কাঁচও ভাঙ্গলো; তড়িঘড়ি জানালা বন্ধ করতে গিয়ে ধুলোয় চোখ ভরে গেল, দমকা বাতাসে সপাট করে জানালা ছুটে এসে আঙ্গুলও মচকে গেল শাহিদের। এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকার ঘরে নিজেই বিছানা-বালিশ ঝেড়ে বালু ছাড়ালো, তারপর একটা মোম জ্বেলে বিছানায় সটান শুয়ে পড়লো সে।
ধীরে ধীরে টেলিফোনের নেশা চাঙ্গা হতে থাকে। ঘরময় ভ্যাপসা গরম, তার মনে অশান্তির জ্বালা, নেশার তীব্র যন্ত্রণা।
মিমিদের ওখানে কি ঝড় হয়েছে? বিদ্যুৎ চলে গেছে? শাহিদ শুয়ে শুয়ে ভাবে। মিমিদের বাসা গেন্ডারিয়াতে। ৫৩, দীননাথ সেনরোড। অবশ্য এটা যে সত্যিকারের ঠিকানা তা না-ও হতে পারে। শাহিদদের বাসা মিরপুর-১১ নম্বরে। মিরপুর ও গেন্ডারিয়ার মাঝখানে দূরত্ব প্রচুর, দু-জায়গায় কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে লোড শেডিংয়ের সম্ভাবনা খুব কম। তবে ঝড় হলে ব্যাপ্তি বেশি হয়, তখন হয়তো অর্ধেক কিংবা সারা শহর জুড়েই লোড শেডিং পড়ে যায়।
লোড শেডিং হলে শাহিদের জন্য একটু সুবিধা আছে ~েবকি, অন্তত সে নিজে তাই ভাবছে। অন্ধকারে ঘরের কাজ-কর্মের জন্য মিমিকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হবে না, ফোনে রিং বাজা মাত্র রিসিভার তুলে বলবে, হ্যালো স্লামালাইকুম। একটা সম্ভাবনার কথা সে খুব ভাবছে। হয়তো শাহিদের মতোই সে এখন কাত হয়ে ফোনের পাশে বসে আছে। ওপরে যতোই রাগ দেখাক আসলে মনে মনে সে নিশ্চয়ই তার সাথে কথা বলার জন্য অধীর আগ্রহে বুঁদ হয়ে থাকে। তার এই বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হয়েছে গতকালের ঘটনা থেকেন হ্যাঁ, ঘটনাই বলা যায়ন্সর্বশেষ মাত্র একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে লাইন কেটে দিবে বললেও রসিয়ে রসিয়ে ৪০ মিনিটেরও ওপরে কথা বলেছে মিমি।
চুম্বকের একটা ধর্ম আছেন্সমমেরুতে বিকর্ষণ, বিপরীত মেরুতে আকর্ষণ, যে-কথা ইতোমধ্যে সে মিমিকে বলেও বসেছে। চতুর ও বুদ্ধিমতি মেয়েরা সর্বদা জ্ঞবিপরীত মেরুরঞ্চ ~ে~~বশিষ্ট্য বহন ও প্রয়োগ করে, যাতে গর্দভ ছেলেগুলো মেয়েদের দিকে প্রচণ্ড বেগে ধাবিত হয়। মিমি নিশ্চয়ই সেরকম মেয়ে, শাহিদকে সে নাচিয়ে দেখছে, নাচাচ্ছে।
শাহিদ অবশ্য নিজেকে গর্দভ মনে করে না, সে গর্দভ সেজে এর শেষ দেখতে চায়। মিমির মধুঝরা কণ্ঠস্বর তাকে এখনো ঘোরের জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
খুব আয়েশ করে ফোন করলো শাহিদ। রিং যেতে থাকে। অল্প কয়েকবার রিং বাজার পরই রিসিভার তুলে খুব ব্যস্তভাবে মিমি বলে উঠলো, হ্যালো স্লামালাইকুম।
শাহিদ টেনে টেনে বলেঃ
এখানে ঝড় উঠেছিল, বিদ্যুৎ নেই,
দুঃসহ গরম, জ্বলছি অন্তর্দহনে,
শিয়রে ম্লান মোম-শিখা, এ বিষণ্ন সময়ে
একটু প্রশান্তি আমি খুঁজি দূর-আলাপনে।
তীক্ষ্ণ ও কঠিন ঝাঁঝালো স্বরে মিমি বলে উঠলো, আপনার কবিতা শোনার মতো সময় আর ~েধর্য্য আমার নেই। তারপরই সে খ-স করে রিসিভার নামিয়ে রাখে। নিষ্ঠুর শব্দটি ভীষণ বেগে এসে শাহিদের বুকের মধ্যে আঘাত হানেনতার বুকের মাঝখানটা গ্রীষেমর বৃষ্টিহীন মাঠের মতো ফেটে চৌচির হয়নপ্রচণ্ড একটা চোট লাগে। মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়। কী রহস্যময় এক মেয়েনতার মনের খবর বোঝা কী দায়, কখনো তার মুখে খই ফোটে, মনের ভিতরে তখন আশা জাগে, কখনো সে নিষ্ঠুর হৃদয়হীনা, কী এক রহস্যময় নারী!
শাহিদের সাথে কথা বলতে কি মিমির একটুও ভালো লাগে না? কখনো মনে হয় ভালো লাগে, কখনো মনে হয় সে অতিশয় বিরক্ত। এমনকি কোন যৌবনবতী নারী আছে যে কখনো কোন এক যৌবনপ্রাপ্ত পুরুষের সাথে কথা বলে সুখ পায় না? হোক সে বিবাহিতা, কিংবা কুমারী, এটা তো নারীর অন্তরের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষানএকজন পুরুষের সাথে কথা বলা, গোপনে গোপনে ভিজে যাওয়া। গত দুটো দিন মিমির সাথে কথা বলে শাহিদের কী যে ভালো লেগেছেনকিন্তু মিমিরও কি তেমনি ভালো লাগেনি? শাহিদ ভেবে ভেবে কোন কূল পায় না। নারীরা সত্যিই বড় বিচিত্র, কঠিন তাদের মনের খোঁজ পাওয়া।

শান্তা মেহরিনের সাথে তার যোগাযোগটাও একটা অদ্ভুত রহস্যে ভরা।
ইন্টারনেটে চ্যাট ওয়েবসাইটে ঢুকলে সব সময়ই কয়েকটা কমন নাম সেখানে ভেসে থাকতে দেখা যায়, যেমন সজনী, চম্পাবতী, সেলিনা, রুমা, সোমা, অনামিকা, কলাবতী, কলাপাতানবাংলাদেশি সবকটা ওয়েবসাইটেই এই কমন নামগুলো সর্বদা ভাসমান এবং বিরাজমান। শাহিদ চ্যাটরুমে ঢুকলে এ নামগুলোতে একবার-দুবার করে নক করেনহ্যালো, হাউ আর ইউ? তোমার কি ঘুম নেই? অন্য কোন কাজও নেই, একমাত্র চ্যাটিং ছাড়া? কিন্তু ওগুলো থেকে কোন উত্তর সে অদ্যাবধি পায়নি। অন্যান্য ফিমেল চ্যাটারের সাথে অবশ্য তার চ্যাট হয়েছে। একদিন সহসা মেহরিন নামটির ওপর নক করতেই সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পাওয়া গেল এবং তার সাথে বেশ চ্যাট হলোঃ

তোমার ভাল নাম কী?
শান্তা মেহরিন।
চমৎকার নাম।
ধন্যবাদ । তোমার নাম জানতে পারি কি?
অবশ্যই। শাহিদ কামাল।
নাশিদ কামালের ভাই?
গায়িকা নাশিদ কামালের কথা বলছো?
হুম।
তিনি আমার প্রিয় গায়িকা। কিন্তু তাঁদের সাথে আমাদের কোন আত্মীয়তা নেই।
নেভার মাইন্ড।
তুমি কী করো?
পড়ালেখা করি।
কোন্ ক্লাসে?
ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।
কলেজ?
লালমাটিয়া কলেজ।
কোন গ্রুপে পড়ো তুমি?
সায়েন্স।
এস.এস.সি. কোন্ স্কুল থেকে পাশ করেছো?
স্যরি, আমাকে শীঘ্রই উঠতে হবে।
কেন?
বাবা আমার ঘরের দিকে আসছেন।
তুমি এখন বাসা থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করছো?
এর কোন উত্তর এলো না, তার বদলে নিচে লাল অক্ষরে ভেসে উঠলোনমেহরিন চ্যাটরুম থেকে প্রস্থান করেছে।
এর ঠিক তিন দিন পর অন্য আরেকটা চ্যাট ওয়েবসাইটে কাকতালীয়ভাবে শান্তা মেহরিনের সাথে চ্যাট হলো।

আমাকে চিনতে পারছো? আমি শাহিদ কামাল।
তুমি ইটালি থেকে বলছো, তাই না?
স্যরি, আমি বাংলাদেশ থেকেই বলছি। এই তো মাত্র তিন দিন আগে চ্যাটরুমে তোমার সাথে দেখা, তোমার বাবা ঘরের দিকে আসছিলেন, তুমি দ্রুত চ্যাটরুম ছেড়ে চলে গেলে। মনে পড়ে?
হিমম---এ রকম তো অবশ্য প্রায়ই হয়, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। এনি ওয়ে, তুমি ভালো আছো তো?
হ্যাঁ। তুমি?
আমিও, ধন্যবাদ।
তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?
পড়ালেখা মানে?
তুমি এইচ.এস.সি. সেকেন্ড ইয়ার পড়ছো না?
নোওউপ।
কিন্তু তুমি সেদিন তাই বলেছিলে।
স্যরি, আমি কখনো আমার পড়ালেখার কথা কাউকে বলি না।
তোমার নামটা কি বলবে?
কেন? এনি কনফিউশন?
আমি মিলাতে পারছি না।
অলরাইট, আই এ্যাম শান্তা মেহরিন।
এক সময় লালমাটিয়া কলেজে পড়তে, তাই না?
ঠিক তাই। কিন্তু জানলে কী করে?
সেদিন বলেছিলে।
নোওউপ।
তুমি কী করো?
আমি একটা জব করছি।
কী ধরণের জব?
বিমানে।
তুমি কি বিমানবালা?
আমার স্পেসিফিক পেশাটা কাউকে বলি না।
আমার অনুমান তুমি বিমানবালা অথবা কাষ্টমস অফিসার। ঠিক?
স্যরি, বলতে পারবো না।
তোমার কোন মোবাইল আছে?
আছে। তোমার?
আমার মোবাইল নেই, তবে ল্যান্ডফোন আছে । ৮১২৩৪৪১।
ও-কে।
নোট করেছো?
হিমমম।
তোমার নামের পাশে যে সংখ্যাটা ওটা কি তোমার মোবাইল নম্বর?
চমৎকার!
কী?
তোমার বুদ্ধি।
কেন?
আমার মোবাইল নম্বরটা ধরতে পারলে। আজ পর্যন্ত অন্য কেউ পারেনি।
প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। তবে এটা কাকতালীয়। প্রকৃতপক্ষে আমি খুবই বোকা।
অসম্ভব।
বিশ্বাস হয় না?
তুমি খুব ভালো ইংরেজি লিখছো।
এ দ্বারা বুদ্ধির পরিমাপ হয় না।
স্যরি, আমাকে উঠতে হবে।
কেন, খুব তাড়া?
আমার ডিউটির সময় হয়ে গেছে।
আমি কি কখনো মোবাইলে ফোন করতে পারবো?
আমি তোমার ফোন উপভোগ করবো।
এখনই করি?
নো প্লিজ, এখন আমি মোবাইল বন্ধ রাখবো।
আবার কি চ্যাটরুমে দেখা হবে?
হতে পারে।
কবে, কখন?
এটা নিশ্চিত বলতে পারছি না। তবে আমাকে খুঁজে বের করে নিও।
কাল এমন সময় কি আশা করতে পারি?
বলতে পারছি না। স্যরি, আমি উঠছি। বাই।
সঙ্গে সঙ্গে নিচে লাল লেখা ভেসে উঠলো।

দুদিনে অবশ্য মেহরিনের দুটি পরিচয় পাওয়া গেছে, প্রথমদিন বলেছিল সে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, আজ বলেছে সে বিমানে চাকরি করে। অথচ তার চ্যাটিং নিকনেমে কোন পার্থক্য নেইনমেহরিন ০১৭১৩০২০৩১। প্রথম দিন অবশ্য শাহিদের মনে পড়েনি যে নামের সাথে যুক্ত এতো বড় সংখ্যাটা আসলে তার মোবাইল নম্বর।
জ্ঞএখনই ফোন করিঞ্চ বলে শাহিদ নিশ্চিত হতে চেয়েছিল যে ওটা সত্যিই মেহরিনের নম্বর কিনা, কিংবা সে শান্তা মেহরিন কিনা। যদিও সে এখনই ফোন করার কথা বলেছিল কিন্তু আদতে তা করতো না, কারণ, তার মোবাইল ফোন নেই। এ দ্বারা অবশ্য ফোনের প্রতি মেহরিনের আগ্রহের পরিমাণটাও আন্দাজ করা গেছে। তবে সে মোটামুটি নিশ্চিত যে মেয়েটি তার আসল পরিচয় প্রথমদিন গোপন করেছিল ঠিকই, কিন্তু আজ আর গোপন রাখতে পারেনি। তবে মাত্র তিনদিন আগের চ্যাটের কথা কি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেল সে? ভুলে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। প্রতিদিন কতো জনের সাথে কতো ধরণের চ্যাট হয়, কার সাথে কী কী চ্যাট হলো তা মনে রাখা মোটেও সম্ভব নয়। এখানেই শাহিদের মনে প্রশ্ননতাহলে কি সে একেক জনের কাছে একেক রকম পরিচয় দিয়ে থাকে? এতে তার লাভ কী? মেহরিনের সাথে কথা বললেই জিনিসটা পরিস্কার হয়।
কিন্তু কোথা থেকে ফোন করা যায়? টেলিফোন বুথে প্রেমালাপ যেমন লাভজনক হবে না, তেমনি জমবেও না। সে পরদিন বন্ধু খান ইমুর সাথে দেখা করেই ওর মোবাইল ফোনটা হাতে তুলে নেয়। তারপর রিং করেন০১৭১৩০২০৩১।
রিং যেতে থাকে।
অপর প্রান্তে মেহরিনের জ্ঞহ্যালোঞ্চ ভেসে আসে। শাহিদ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। বলে, হ্যালো স্লামালাইকুম, মেহরিন বলছেন?
জ্বি বলছি। কে বলছেন প্লিজ?
শাহিদ কামাল বলছি। চিনতে পারছেন তো?
মেহরিন দ্বিধান্বিত স্বরে বলে, চিনতে পারছি না যে।
গতকাল ইন্টারনেটে চ্যাট করলাম, রাতে, মনে পড়ে?
স্যরি, আমি তো কখনো ইন্টারনেটে বসি না ভাই।
কিন্তু আমি তো ইন্টারনেট থেকেই এ নম্বরটা পেলাম।
নাম এবং নম্বর ঠিক আছে, কিন্তু আমি তো কখনো ইন্টারনেট ব্রাউজ করি না।
স্যরি, আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম।
ইটস ওকে।
ম্যাডাম, আপনার সাথে কি মাঝে মাঝে মোবাইলে কথা বলা যাবে?
কেন ভাই, কোন প্রয়োজন আছে?
প্রয়োজন নেই, তবে প্রয়োজন ছাড়া কি আমাদের ফ্রেন্ডশীপ হতে পারে না?
প্লিজ মাফ করবেন, ফ্রেন্ডশীপ করবার বয়স আমার নেই।
স্যরি, রাখি, কেমন?
মহিলা মাঝবয়সী, নাকি তরুণী বোঝা গেল না। কণ্ঠস্বরে কোন অতিরিক্ত আকর্ষণ কিংবা মাধুর্য নেই, তারপরও খুব গুছিয়ে কথা বলেন এবং সেটা শাহিদের ভালো লাগলো। যথেষ্ট ভদ্রভাবেও কথা বলেছেন। তবে তিনি কী করেন সেটা জানা গেল না, জিঞ্চাসা করলে হয়তো বলতেনও। সন্দেহের এক মহাসমুদ্রে সে হাবুডুবু খেতে লাগলো, নাম নম্বর সবই ঠিক আছে, কিন্তু মিলছে না।
পনর দিনের মাথায় রাত আটটার দিকে শাহিদ আরেকবার ফোন করে। অনেকক্ষণ ফোন বাজার পর মেহরিন ফোন ধরেন। তাঁর গলার আওয়াজের সাথে একটা ছোট বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা যায়।
হ্যালো।
হ্যালো স্লামালাইকুম। মেহরিন বলছেন?
জ্বি বলছি। আপনি?
আমি শাহিদ কামাল। দিন পনর আগে একবার ফোন করেছিলাম। আপনি ভালো আছেন?
জ্বি, ধন্যবাদ। কিছু বলবেন? আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি এখনো।
আপনাকে আমার সব পরিচয়ই খুলে বলবো। আপনার সাথে কি এক মিনিট কথা বলতে পারবো?
হ্যাঁ, বলুন।
আমি আসলে বুঝতে পারছি না যে আপনার ফোন নম্বরটা কীভাবে আমার কাছে এলো। আপনি কি সত্যিই ইন্টারনেটে চ্যাট করেন না?
আরে ভাই, সবই ঠিক আছে, কিন্তু আমি ইন্টারনেটে কখনো ঢুকি না।
তাহলে নম্বরটা আমি কীভাবে পেলাম?
সেটা আমি কী করে বলবো?
কাঁদছে কি আপনার বাচ্চা?
আমার বাচ্চা না, আমার নাতনি।
ম্যাডাম, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত এবং লজ্জিত।
ইটস ওকে।
শাহিদ ঘেমে উঠেছিল। ইন্টারনেটের সেই শান্তা মেহরিনের সাথে সে আর কোনদিন যোগাযোগ করেনি।


শান্তা মেহরিনের পর তানিয়ার সাথে বেশ কিছুদিন ই-মেইলে যোগাযোগ হয়েছিল। তানিয়াকে ইন্টারনেটে পাওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য বেশ রোমাঞ্চকর ছিল।
ইমুর কাছ থেকে জ্ঞআই-ফ্রেন্ডসঞ্চ নামক নতুন একটা ওয়েবসাইটের সন্ধান পেয়েই শাহিদ ওটায় ঢুকেছিল। সেখানে প্রথম পৃষ্ঠায় বন্ধুত্ব, বিয়ের জন্য সঙ্গী খোঁজার সার্চ ইঞ্জিন ছিল। ১৮ থেকে ৩০ বৎসর বয়সী বাংলাদেশি মেয়েদের সার্চ দিতেই যে দীর্ঘ তালিকাটি তার সামনে ভেসে উঠলো তা দেখে শাহিদ পাগল হয়ে গেল। সে একেকটা মেয়ের পূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত পড়ে আর যারপরনাই উত্তেজিত হতে থাকেনজ্ঞনির্মল বন্ধুত্বের জন্য সত্যনিষ্ঠ, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছেলেদের চাইঞ্চ। জ্ঞসাহিত্য যারা ভালবাসেন, সঙ্গীত যাদের নিত্যসঙ্গী, এমন মননশীল সংস্কৃতিমনা যুবকদের সাথে বন্ধুত্বে আগ্রহীঞ্চ। এতোসব শাহিদ পড়ে আর মনে মনে পাগল হয়ে ওঠে।
প্রায় দেড়শোটি মেয়ের কাছে ই-মেইল করা হলো।
একই নামের অবশ্য একাধিক মেয়ে রয়েছে। কেউ ছাত্রী, কেউ নতুন পেশা খুঁজছে, কেউবা ইতোমধ্যে পেশা গ্রহণ করেছে।
গোটা বিশেক মেইল অবশ্য প্রাপকের কাছে না পৌঁছে ডেলিভারি ফেইলিইওর হিসাবে ফেরত এলো। অনেকে বহুদিন আগেই ই-মেইল একাউন্ট ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে, নির্ধারিত সময় শেষে তা ইনভ্যালিড হয়ে গেছে। কেউবা হয়তো ই-মেইল একাউন্টটি শুদ্ধভাবে ঢোকায়নি।
মাস খানেকের মধ্যেও কারো কোন জবাব না পেয়ে শাহিদ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে যে-সব নাম-ধাম-বৃত্তান্ত দেয়া আছে আসলে তা সবই ভুয়া। কিন্তু তারও দিন দশেক পরে যখন তানিয়া নামক মেয়েটির একটা জবাব এলো তা দেখে শাহিদ ভীষণ রোমাঞ্চিত ও আশ্চর্য হলো। তানিয়া লিখেছেঃ

হাই,
আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি যে তুমি আমার কাছে মেইল করেছো। আরো খুশি হয়েছি যে তুমি আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাও। আসলে ব্যাপারটা হলো কী, আমি তোমার মেইল পেয়ে একটু বিব্রতবোধ করছি এবং লজ্জিত বোধও করছি। কেননা, তুমি যেখান থেকে আমার নামটা সংগ্রহ করেছো ওখানে আমি নিজে আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করিনি। আমার একটা দুষ্ট~ু বোনঝি আছে, ও এবার ঢাকা ভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। তো, সেই দুষ্টু রাহা (ওর নাম রাহা) গোপনে, আমাকে একেবারেই না বলে আমার নামটি ঢুকিয়ে দিয়েছে। ব্যস, তোমার মেইলটা পেয়ে গেলাম।
আমার লাইফ ডিটেইলসে যে লেখা আছে জ্ঞউপযুক্ত এবং ব্যক্তিত্ববান যুবকের সাথে বিয়ে সম্ভবঞ্চ ওটা আসলে ওর একেবারেই বানানো। আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না। কেবল একটা চাকরিতে ঢুকলাম তো। ক্যারিয়ারটা ঠিক মতো গড়ে উঠুক, তারপর বিয়ের কথা ভাববো। এটাই কি সঠিক সিদ্ধান্ত নয়?
আমি তানিয়া আহমেদ চৌধুরী। গুড লাক।

মেইলটা পড়ে শাহিদ মনে মনে হাসলো। তারপর একটা সুন্দর উত্তর লিখলো।

হ্যালো অপরিচিতা, তানিয়া আহমেদ চৌধুরী,
আপনার সুন্দর মেইলটি আপনার প্রতি আমার আগ্রহ দুর্বার করে তুলেছে। আপনি কোথায় চাকরি করছেন তা কিন্তু বলেননি। তবে, এ মুহূর্তে বিয়ের কথা না ভেবে চাকরি ক্ষেত্রে উন্নতি করতে চাইছেন এজন্য আপনাকে আমি সাধুবাদ জানাই, খুব কম মেয়েই এতোখানি সাহস ও সংযম প্রদর্শন করতে পারে।
একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে, আপনার দুষ্টু বোনঝি কি সারাক্ষণ শুধু ইন্টারনেটেই পড়ে থাকে? আমার তো মনে হয় সে সারাদিন ইন্টারনেটে পড়ে থাকে আর আপনার নামে গন্ডায় গন্ডায় একাউন্ট খুলতে থাকে। বিষয়টি পরিস্কার করে বলছি। আপনার নামে ওয়েবসাইটে পাঁচটি একাউন্ট খোলা আছে। পাঁচটি একাউন্টে ব্যক্তিগত পাঁচটি বৃত্তান্তে পাঁচ রকমের বক্তব্য দেয়া আছে। যেমনঃ

প্রথমঃ হাই, আমি গান পছন্দ করি। অবিবাহিতা। কলেজে ২য় বর্ষে পড়ছি। সংস্কৃতিমনা কিন্তু সমার্ট যুবকদের সাথে বন্ধুত্বে আগ্রহী।
দ্বিতীয়ঃ হ্যালো, আমি তানিয়া, ভ্রমণ করতে ভালোবাসি। টিভি দেখা, বই পড়া আমার শখ। এখনো বিয়ে করিনি। ভার্সিটিতে ২য় বর্ষ। যে কারো সাথে নিস্কলুষ বন্ধুত্বে আগ্রহী।
তৃতীয়ঃ আমি তানিয়া রহমান। যে কোন কিছু হতে পারে। সুপুরুষরা আমাকে সর্বদাই আকর্ষণ করে।
চতুর্থঃ উপযুক্ত এবং ব্যত্তিত্ববান যুবকের সাথে বিয়ে সম্ভব।
পঞ্চমঃ আমি জীবনকে উপভোগ করতে চাই, যে কোন উপায়ে। কোন সাহসী যুবক আছেন কি? কিংবা পুরুষ?

বিভিন্ন সহানে এরূপ বিচিত্রভাবে নাম ছড়ানোর রহস্যটা কি জানতে পারি?
ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
দ্রুত উত্তরের প্রত্যাশায়নশাহিদ কামাল।

তিনদিনের মাথায় তানিয়ার জবাব এলো।

হ্যালো শাহিদ কামাল, কিংবা যেই হোন না আপনি, আপনার মেইল আমাকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করেছে। প্রথম মেইলে আমি স্পষ্ট জানিয়েছিলাম যে রাহার দ্বারা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এ কাজটি করা হয়েছিল। আপনি আমাকে অবিশ্বাস করেছেন, সঙ্গে আরো চারটি মেয়ের ব্যক্তিগত মন্তব্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু জনাব, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যে আমার নামটা তানিয়া আহমেদ চৌধুরী এবং আমার পুরো নামের সাথে অন্য কারো নামেরই কোন মিল নেই? কেউ তানিয়া মাসুদ, কেউ তানিয়া রহমান, কেউ শুধু তানিয়া। অতএব আমার সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য একেবারেই মেনে নিতে পারছি না। বলুন তো কে আপনি, এরূপ মিথ্যে অভিযোগের সাহস আপনার কোত্থেকে এলো?

মেইলটি দেখার পর শাহিদ পুনরায় ওয়েবসাইট খুলে পাঁচটি পৃথক জায়গায় তানিয়ার পার্সোনাল প্রোফাইল ভালো করে দেখে নিল। তারপর উত্তর পাঠালোঃ

হ্যাঁলো তানিয়া আহমেদ চৌধুরী,
আপনার মেইলের জন্য এবারও আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ওয়েবসাইটে পাঁচটি পৃথক অথচ অভিন্ন তানিয়ার প্রোফাইল দেখে এবং আপনার মেইল পড়ে আমি খুউব বিসিমত হচ্ছিনএটা কি করে সম্ভব হলো? হ্যাঁ, সেটাই বলছিনপাঁচটি পৃথক জায়গায় তানিয়া আহমেদ, তানিয়া আহমেদ চৌধুরী, তানিয়া মাসুদ, তানিয়া রহমান ও তানিয়া নামক পাঁচটি মেয়ের প্রোফাইল দেয়া আছে। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, এটা কীভাবে সম্ভব হলো যে তাদের প্রত্যেকেরই জন্ম তারিখ অভিন্ন, বাসার ঠিকানাটাও একই। একই বাসায় একই দিনে পাঁচটি মেয়ের জন্ম হলো, তাদের নিক নেইমটাও রাখা হলো অভিন্ননতানিয়ানএর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কি হতে পারে? আপনিই বলুন, এটা কি কখনো সম্ভব? কীভাবে সম্ভব?
অতএব, আমি সুনিশ্চিত, পাঁচটি তানিয়া আসলে একটি অভিন্ন সত্তা। আপনি যে-ই হোন না কেন, আপনার অন্তরে কোন সুপ্রবৃত্তির অবস্থিতি নেই বলেই আমার বিশ্বাস। আমি আরো সুনিশ্চিত যে, আপনার বোনঝি রাহাটাও অন্য কেউ নয়, স্বয়ং আপনিই।
আমার ধারণা আপনি একটা কলগার্ল। তাহলে এতো ভণিতা কেন, সোজাসুজি অফার দিলেই পারতেন?
অজস্র ধন্যবাদের পরনশাহিদ কামাল।

তানিয়ার উত্তর ছিলঃ

আপনার সর্বশেষ মেইলটা পড়ার পর থেকে আমি তীব্র অন্তর্দহনে জ্বলছি। আমার এ যন্ত্রণা কোনদিন শেষ হবে না, কেউ দেখবে না।
আপনার সকল অভিযোগ আর অপবাদ মাথা পেতে নিচ্ছি।
কিন্তু আপনি একটা পাষণ্ড।

এরপর শাহিদ বহুবার দীর্ঘ জবাব পাঠিয়েছে, ক্ষমা চেয়েছে, অনুশোচনা প্রকাশ করেছে, কিন্তু তানিয়ার কোন জবাব আসেনি।


পর্ব-৩

রাগ করে, কিংবা বিরক্ত হয়ে, ক্ষুব্ধ মিমি যখন কথা না বলেই খট করে রিসিভার নামিয়ে রেখে দিয়েছিল, নিজের প্রতি শাহিদের খুব ঘৃণা ধরে গিয়েছিল। মনে মনে প্রতিঞ্চা করেছিল, আর কখনোই মিমিকে ফোন করবে না। কী-ই বা এমন যাদু আছে তার কণ্ঠস্বরে যে তাকে ফোন করতেই হবে? মাস দুয়েক পর্যন্ত সে মিমিকে আর ফোনই করলো না।
কিন্তু যতোই সে নিজের প্রতিঞ্চায় অটল থাকতে চায়, ততোই ফোন করার জন্য তার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে।
বৃষ্টি-ধোয়া একটি বিকেল, বাইরে বেরুবার ইচ্ছে নেই, মনটা তার দারুণ বিষাদময়, শাহিদ আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না।
৭৪১৭০৯৯
ক্রিংক্রিং ক্রিংক্রি ক্রিংক্রিং
হ্যালো স্লামালাইকুম। মিমির নরম ও মিষ্টি কণ্ঠস্বর।
স্লামালাইকুম। ভালো আছেন? শাহিদও নরম করে জিঞ্চাসা করে।
মিমি স্বল্পক্ষণের দম নেয়। তারপর সামান্য টেনে টেনে বলে, হ্যাঁ-----।
দুঃখিত যে আপনাকে বিরক্ত করছি। আপনি কি এখন খুবই ব্যস্ত?
একটুন
ঠিক আছে তাহলে, রেখে দিই?
ঠিক আছে, কথা বলতে না চাইলে রেখে দিন।
আপনি এতো নিষ্ঠুর কেন, বলুন তো?
এতে নিষ্ঠুরতার কী হলো?
আপনি খুবই আঘাত দিয়ে কথা বলেন।
কী জানি ভাই, আমি আমার মতো করে বলি, তাতে কেউ আঘাত পেলে আমি কী করতে পারি?
আপনার এ কথাটিও শেলের মতো আমার বুকে বিঁধছে।
কেন?
আপনার কথায় আমি কষ্ট পাই, আপনি সব সময়ই এটা চান। তাই না?
আমি আসলে এভাবেই কথা বলি।
হ্যাঁ, তা খুবই বুঝতে পারছি।
আচ্ছা, আপনি কী করেন জানতে পারি কি?
অবশ্যই পারেন।
কী করেন?
এখন বলতে চাইছি না যে।
আচ্ছা ঠিক আছে, না বললে না বলবেন, এটা জানার এতো শখ নেই আমার।
ওওউফ, কী সাংঘাতিক নিষ্ঠুর আপনি!
এসব পেঁচাল বাদ দিন।
বাদ দিলাম। আচ্ছা আপনি কী করেন?
পড়ালেখা করি।
ও ইয়েস, মনে পড়ছে, জুলাইয়ে আপনার পরীক্ষা, না?
জুলাইয়ে মানে?
আপনি বলেছিলেন জুলাইয়ে আপনার মাস্টার্স ফার্ষ্ট পাঢর্~ পরীক্ষা।
ওওফনমিমি হেসে ওঠে। আপনি দেখি আমার সব কথা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখেন।
তাহলে কি ওটা ভুল ছিল?
কোন্টা?
জুলাইয়ে পরীক্ষা হওয়ার কথা?
কী জানি, আমি কি সত্যিই বলেছিলাম?
বলেছিলেন।
আমার মনে নেই।
আপনি কোন্ বিষয়ে পড়ছেন?
সোশ্যাল ষ্টাডিজে।
অনার্স?
হুম।
কোন্ ইয়ার?
থার্ড ইয়ার।
ঢাকা ভার্সিটি?
ইডেন কলেজ।
আপনার রোল নম্বর কতো?
ও মাই গড, আমি দেখি আপনাকে সবই বলে দিচ্ছি। নো নো নো, নো মোর ডিটেইলস এবাউট মি।
ও-কে, নো প্রোবলেম। কলেজের ঠিকানায় আপনাকে চিঠি পাঠাবো, কোন অসুবিধে নেই তো?
মানে?
আপনার কাছে চিঠি লিখবো।
সর্বনাশ!
কেন?
ঐ চিঠি আমার হাতে তো আসবেই না, উল্টো কার হাতে পড়ে যায়নশেষে সারা কলেজে রটে যাবেনখবরদার, এ কাজ কক্ষণোই করবেন না, বিলকুল না।
তাহলে আপনাদের বাসার ঠিকানায় পাঠাই?
ও-মা, তাহলে তো আর রক্ষা-ই নেই।
কেন?
আমাকে কলংকিনী কংকাবতী করে ঘর থেকে চুলের মুঠি ধরে বের করে দিবে।
ক্ষতি কী?
ক্ষতি নেই বলছেন? আপনি জানেন আমার হাজব্যান্ডের কথা?
আমি এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছিনআপনার স্বামীকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবেন, দেখবেন আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি আপনার প্রতীক্ষায়।
বাব্বাহন
বিশ্বাস হয় না?
না।
কেন?
আপনার স্ত্রী কি আপনার কথাগুলো শুনতে পাচ্ছেন না?
কীভাবে শুনবে?
উনি এখন বাসায় নেই?
না, একটু বাইরে গেছে।
বাসায় অন্য কেউ নেই?
হ্যাঁ, আছে।
আর কারা কারা আছে?
আমার নাতি আছে। দুই ছেলের দুই বউ আছে।
তারা শুনতে পাচ্ছে না?
আমার রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছি।
আপনি খুব চতুর।
তবু বুদ্ধিমান বলবেন না?
আপনার ছেলেরা কে কী করে?
চাকরি করে।
দুজনেই?
দুজনেই।
কোথায়?
একজন দেশে, আরেকজন বিদেশে।
বিদেশে কতো বছর ধরে?
প্রায় তিন চার বছর।
এক নাগাড়ে?
বছর খানেক পর পর বাড়ি আসে।
বিদেশে চাকরি করে কেন? দেশেই তো একটা কিছু করতে পারতো।
মনে নেই, একদিন বলেছিলাম?
আপনার বউরা কি আপনার সেবা করে?
খুউব।
তাদের সাথে রাগারাগি করেন না?
তারা আমার মেয়ের মতো।
তাই?
ভীষণ বিরক্ত করে।
কী রকম?
দশটার মধ্যেই নাস্তা খেতে হবে। অথচ এগারটার আগে আমার ঘুমই ভাঙ্গে না।
বড় অদ্ভুত তো, এগারটা পর্যন্ত কেউ ঘুমায়?
হ্যাঁ, ঘুমায় তো, আমার ছোট বউটা খুব অলস, আর ঝগড়াটে। অবশ্য খুব শিক্ষিত, সে বারোটার সময় ঘুম থেকে উঠে তার শাশুড়িকে বলবে, মা, লাঞ্চ কি রেডি হয়েছে?
মিমি কলকল শব্দে হাসতে থাকে।
শাহিদ বলে, হাসছেন যে?
হাসির কথা বললে কি কেউ কাঁদে?
এটা মোটেও হাসির কথা নয়।
আপনি মাঝে মধ্যে এমন কথা বলেন যে ঘুমের মধ্যেও কখনো কখনো হেসে ওঠি।
আমি ধন্য হয়ে গেলাম।
কেন?
আমার ধারণা ছিল যে দীর্ঘ দিবস ও দীর্ঘ রজনী কেবল আমিই একজনের কথা ভাবি, এখন দেখছিন
আপনার ধারণা ভুল ছিলনতাই বলতে চাইছেন?
একজ্যাক্টলি।
আচ্ছা, আমার কথা কি আপনার বউকে বলেছেন?
হ্যাঁনএকটা শব্দও গোপন রাখি না।
উনি কী বলেন?
মিটিমিটি হাসেন।
অবিশ্বাস্য।
বিশ্বাস করানোর জন্য কী করতে পারি?
কিচ্ছু না।
আপনি বই টই পড়েন?
আগে প্রচুর পড়তাম। এখন পড়ি খুব কম।
কম কেন?
ঘর-সংসার সামলানো, কলেজের পড়ালেখান্সময় কোথায়?
পড়ালেখা করবেন, আবার ঘর-সংসারও করবেন? দুটো তো একসঙ্গে হয় না। এসব সংসার টংসার বাদ দিন।
সংসার বাদ দিব? মেয়েদের জন্মই তো রান্নাঘর সামলানোর জন্য, বাচ্চা কাচ্চাদের বিছানা-বালিশ-পায়খানা-প্রসাব পরিস্কার করার জন্য, এর মধ্যে লেখাপড়া করাটা হলো একটা উপড়ি কাজ।
মানলাম না।
মানবেন কেন? আপনিও কি পুরুষ না?
মানে?
পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষরা কি নারীদের কথা মানে? তারা যা বলবে নারীদেরকে তার সবই মাথা পেতে নিতে হবে, সইতে হবে।
বাব্বাহ, আপনার অন্তরেও তাহলে একজন তসলিমা নাসরিন আছেন?
আমি তসলিমা নাসরিন হতে যাবো কেন? এটা সব নারীরই মনের ক্ষোভ।
আমি কি তাহলে ধরে নিতে পারি না যে প্রত্যেকটা নারীই একেকটা তসলিমা নাসরিন?
আমি এ কথাটা অন্যভাবেও বলতে পারি।
কেমন?
মাটির নিচে সবখানেই আগুন চাপা আছে। বিস্ফোরণ এবং লাভা উদ্গীরণ কিন্তু সব জায়গাতে হয় না।
আপনার মনেও কি ক্ষোভ জমে উঠছে?
নাহ্। জমলেও আমার বিস্ফোরণের কোন সম্ভাবনাই নেই।
কেন?
সব কেনর জবাব নেই।
আপনার উচিত তসলিমা নাসরিনের বই পড়া।
আমি তাঁকে পছন্দ করি না।
কেন?
এটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না।
কিন্তু আশ্চর্য।
কী?
তসলিমা সম্পর্কে আমার স্ত্রীরও একই ধারণা।
আপনার?
তসলিমা সম্পর্কে আমার ধারণা আগের চেয়ে একটু পাল্টেছে।
আপনি তাঁর খুবই ভক্ত, বুঝতে পারছি।
কীভাবে বুঝলেন?
আমার ধারণা, আপনি তসলিমার লেখাকে পছন্দ করেন না। পছন্দ করেন তাঁর গ্ল্যামারকে।
মানে?
তসলিমা একজন আকর্ষণীয়া মহিলা, তাঁর লেখায় একটু অন্য ধরণের স্বাদ আছে, পুরুষরা সেগুলো চানাচুরের মতো লুফে নেয়।
আপনার ইংগিতটার অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার। কিন্তু আমি সে রকম নই।
সে রকম মানে?
মূলত তসলিমা সম্পর্কে আমার, আপনার এবং আমার স্ত্রীর মনোভাবে কোন পার্থক্য নেই।
আমি খুব কম পুরুষের কথাই জানি যারা তসলিমাকে অপছন্দ করেন।
আপনার ধারণাটা ঠিক নয়। তসলিমাকে শুরু থেকেই আমি অত্যন্ত অপছন্দ এবং ঘৃণা করি। তসলিমার ভক্তরা তাঁকে নারীবাদী মহীয়সী বলে, আমার কাছে মনে হচ্ছেনহ্যালো।
জ্বি বলুন, শুনছি।
আমার কাছে মনে হচ্ছে তসলিমা একটা ভীষণ ভোগবাদী মহিলা। আমি কি বোঝাতে পেরেছি?
কিন্তু উনি নিজেকে কী মনে করেন, জানেন?
মনে করেন নারী জাগরণের পথিকৃৎন
ঠিক তাইনউনি ভাবেন যে উনি এদেশের আরেকজন বেগম রোকেয়া।
কিন্তু দুজনের মধ্যে কী বিস্তর ব্যবধান!
তসলিমা যে কী বলতে চান তা কিন্তু পরিষ্কার নয়।
আমার মনে হয় তসলিমা তাঁর উগ্রতা এবং যুক্তিহীনতার জন্যই সাহিত্যে একটা কলংক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।
আমি সাহিত্য ততোখানি বুঝি না এবং এর শিল্পগুণ বা দোষ সম্পর্কেও আমার স্বচ্ছ ধারণা নেই। আমি যেটুকু বুঝি তাহলো, উনি যদি বিতর্কিত বিষয়গুলো না টেনে কেবল নারী মুক্তির জন্য আন্দোলন করতেন, তাহলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার মনেই একটা শাশ্বত স্থান করে নিতে পারতেন।
আমি ঠিক এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম। আপনি কি তাঁর জ্ঞকঞ্চ পড়েছেন?
জ্ঞকঞ্চ আমি পড়িনি। তবে এটা নিয়ে যে সারাদেশে ~েহ ~েচ পড়ে গেছে তা জানি। সর্বশেষ ~েসয়দ শামসুল হকের দশ কোটি টাকার মানহানি মামলার ঘটনাটা আমার কাছে সবচাইতে উদ্ভট মনে হয়েছে। পৃথিবীতে কি এ রকম ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে?
আগের ঘটনার কথা আমার জানা নেই, তবে এর পরের ঘটনার কথা জানি। পশ্চিমবঙ্গে এর আরেকটি সংস্করণ আছে, যার নাম জ্ঞদ্বিখন্ডিতঞ্চ, সেখানে অবশ্য কিছু অতিরিক্ত তথ্য বা ঘটনা যাই বলুন না কেন, আছে। তা পড়ে পশ্চিম বঙ্গীয় অনেকেই ক্ষেপে গেছেন এবং কবি ~েসয়দ হাসমত জালাল ১১ কোটি রুপির মানহালি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলা করে কি এঁদের কোন লাভ হবে?
এরূপ তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের ফলে জ্ঞকঞ্চ এর বিষয়বস্তুর সত্যতা নিয়ে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হবে, তার ফলে একটা সাময়িক ফায়দা এবং সমর্থন হয়তো এঁরা পাবেন। কিন্তু মামলা নিস্পত্তি হোক বা না হোক, এই মামলা বা তার ফলাফলেরর কথা আজকের পাঠকরা ভুলে না গেলেও সময়ের বিবর্তনে আগামী দিনের পাঠকদের কাছে তা হয়তো অজানা রয়ে যাবে। তখন তাঁরা জ্ঞকঞ্চ এর সব কথাই সত্য বলে ধরে নিবেন।
এঁদের উচিত ছিল মামলা না করে প্রতিবাদ স্বরূপ আরেকটা বই লিখা।
কিন্তু এঁরা তা করেননি। এজন্যই এঁরাও বিতর্কিত হয়ে গেলেন।
আচ্ছা, জ্ঞকঞ্চ এর পর কি তসলিমা জ্ঞখঞ্চ লিখবেন? আমি বলতে চাচ্ছি যে, এটা কি জ্ঞকঞ্চ দিয়ে শুরু ধারাবাহিক আত্মজীবনী?
এটা অনেকইে বলেন। কেউ কেউ না জেনে না বুঝে এই ধারণা করেন, কেউ কেউ ঠা-া করে বলেন।
আপনি কী বলেন?
আমি কী বলি তার আগে আমার নিজের অবস্থানটা সুনির্দিষ্ট করে বলে নিচ্ছিনআমি তসলিমার মত বা মতবাদের সাথে একমত নই। জ্ঞকঞ্চ পড়ার আগ পর্যন্ত তাঁর নাম শুনলে আমার গায়ে আগুন জ্বলে উঠতো, তাঁর লেখা পড়ে আমার শরীর রি রি করতোনযতোসব অযৌক্তিক যুক্তি, অসত্য তথ্য, উগ্রতা আর যৌনতায় ভর্তি। কিন্তু জ্ঞকঞ্চ পড়ার পর আমার মনের মধ্যে সামান্য পরিবর্তন এসেছে। খুব হাসছেন যে?
তসলিমা নামে যে পুরুষমাত্রই পাগল, এখন হাতে নাতে তার প্রমাণ পেলাম।
আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি।
মনে হয় শেষ হবেও না।
কেন?
এ আলোচনার কোন আদি-অন্ত নেই।
আপনি বোধ হয় বিরক্ত হচ্ছেন।
নাহ্, বলুন।
স্যরি, আপনার মতো আমি সুন্দর করে কথা বলতে পারি না।
আমি কি সুন্দর করে কথা বলি?
আপনি সুন্দর করে কথা বলেন, গুছিয়ে বলেন, শুনতে খুব ভালো লাগে। কবিতার মতোনচুল তার কবেকারনন।
আপনি একেবারেই অন্য রকম, ব- অন্য রকম। খুব হাসাতে পারেন। কিন্তু নিজে হাসেন না।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
কেন?
অতি সুন্দর করে একটা মিথ্যে বলে আমাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য।
যাহ্, মোটেও মিথ্যে বলিনি।
আচ্ছা, আপনি কি জ্ঞকঞ্চ পড়বেন?
হয়তো পড়বো, তবে এখন না, পরীক্ষার পর।
পরীক্ষা কবে?
নভেম্বরের ২৬ তারিখে।
সে তো বহু দেরি।
কঠিন সিলেবাস। হিমশিম খাচ্ছি।
আচ্ছা ঠিক আছে। পরে হলেও অন্তত পড়ে নিবেন।
বললেন না যে বইটির নাম জ্ঞকঞ্চ হলো কেন?
আমার ধারণা, বইটির নামকরণের মধ্যে তসলিমা তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। বইটির প্রচ্ছদে নাম লেখা জ্ঞকঞ্চ। মলাট উল্টোলেই তিন শব্দে লেখা জ্ঞকথা ক বকুলিঞ্চ। আমি যখন পড়তে শুরু করি, এ কথাগুলোকে তখন মোটেও পর্যাপ্ত অর্থবহ মনে হয়নি। সাত আটটা পরিচ্ছেদ পড়ার পর যে কাহিনীটা শুরু হলো তা এ রকমনএকদিন সকালে তসলিমা তাঁর নিজ কর্মস্থল হাসপাতালে উপসিহত হয়েই দেখেন এক মাঝ বয়সী মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে তাঁর চেম্বারে বসে অপেক্ষায় আছে। মেয়েটির সর্বাঙ্গে অত্যাচারের চিহ্ন। নিষ্ঠুর নির্দয় স্বামী ~েপশাচিক আঘাতে তার সারা গায়ে দাগ করে ফেলেছে। করুণ বিষণ্ন জড়োসড়ো মেয়েটি চেম্বারের এক কোনে বসে। তার জন্য ওষুধ, চিকিৎসা চাই। শুনছেন?
হুম। তারপর?
তসলিমা মেয়েটিকে জিঞ্চাসা করেন, তোমার কী হয়েছে? মেয়েটি কথা বলে না, মায়াবী আর্দ্র চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। তসলিমা আবার বলেন, বলো, কী হয়েছে তোমার? মেয়েটি কিছুই বলে না। বলে না, বলে না। দুঃখিনী জননী তখন মেয়েকে হাত দিয়ে মৃদু ঠেলা দিয়ে বলে, কথা ক বকুলি। সেই বকুলি আর কথা বলেনি। আমাদের এমন কতো অজানা অত্যাচারিত মেয়ে আছেনযাদের প্রতীক হিসাবে বকুলিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী বকুলির ঘটনা আমার মনের মধ্যে একটা গভীর ছাপ ফেলে দিয়েছে।
নামকরণটা আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে।
আমার কী মনে হয় জানেন, জ্ঞকঞ্চ থেকে যদি বিতর্কিত এবং আপত্তিকর কথাগুলো কেটে দেয়া হতো তবে এটা একটা উৎকৃষ্ট সাহিত্যগুণ সম্পন্ন আত্মজীবনী হতে পারতো।
আমার কাছে তাই মনে হয় না।
কারণ?
কারণ, তসলিমার অস্ত্রই হলো বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করা। এটা তাঁর স্টান্টবাজি, লাইম লাইটে আসার জন্য এবং বইয়ের কাটতি বাড়ানোর জন্য।
তা তো আছেই, আমি স্বীকার করছি। তবে বিতর্কিত বিষয়গুলো না থাকলে এ বইয়ের আবেদন আরো বহুগুণ বেড়ে যেত। আপনাকে বলি, প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদে কোন বিতর্কিত বিষয় নেইনতাঁর আত্ম-সমালোচনা এবং অনুশোচনার কথা আছে এতে। ছোট বোনের বান্ধবীর ভাইকে বাসায় গিয়ে দেখে আসেন, তাঁর বাবার অনুপস্থিতিতে। ভিজিট ফি বাবদ তাঁকে ষাটটি টাকাও দেয়া হয়, তিনি ওটা নেন। পরে জানতে পারেন তাঁর বাবা কোনদিন ওখান থেকে ফি নেননি। তিনি টাকা ফেরত দিতে মনস্থ করেন, কিন্তু তার আগেই বান্ধবীর ভাইটি মারা যায়, কোনদিনই টাকা ফেরত দেয়া হয়নি। কাহিনীটা সম্পূর্ণ মনে নেই, তবে এটি আমাকে খুব ভাবিয়েছে এবং কাঁদিয়েছেও। এর পরের দুটো পরিচ্ছেদও এ রকম করুণ বেদনাময়।
কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না বইটি এতো ঝড় তুললো কেন?
প্রথমতঃ ~েসয়দ শামসুল হককে তাঁর স্বরচিত জ্ঞখেলারাম খেলে যাঞ্চ উপন্যাসের জ্ঞলোচ্চাঞ্চ নায়ক হাসনাতের সাথে তুলনা করা হয়েছে, বলা হয়েছে আসলে হাসনাতের চরিত্রটা ~েসয়দ শামসুল হকেরই চরিত্রের প্রতিরূপ। তাঁর শ্যালিকার সাথে প্রণয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে আরো কটু কথাবার্তা আছে। তবে আমার মনে হয়েছে তসলিমা ধর্মের ওপর সবচাইতে বেশি ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের নামই তিনি শুনতে পারেন না। তিনি বলেছেন, মুনতাসীর মামুনের মতো একজন শীর্ষ বুদ্ধিজীবীর কথাও শুনেছি যে তিনি শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদে যান। অর্থাৎ তাঁর ভাষায় ধর্ম কেবলই মূর্খ ও অবুদ্ধিজীবীদের জন্য। তিনি বলেছেন, ধর্ম কোন কালে কোন দেশে শান্তি দিতে পারেনি, দিয়েছে অশান্তি। এখানেই শেষ নয়, বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ স্থানীয় লেখকগণও নাস্তিক নয়। অর্থ্যাৎ, তাঁর ভাষায় শীর্ষ স্থানীয় লেখক হলেই তাঁকে নাস্তিক হতে হবে, অর্থাৎ নাস্তিক হলেই শীর্ষ স্থানীয় লেখক হওয়া যায়, তাঁরা শীর্ষে উঠেই তখন বুঝে যাবেন যে আসলে সৃষ্টিকর্তা বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। আপনি বলুন, এসব কথা শুনে কার না গা জ্বলে? এসব কেউ সহ্য করতে পারে?
আমার তো এখনই তাঁর চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
একজন বাঙ্গালি মুসলিম মেয়ে হয়ে তিনি যা চাইছেন আমার মনে হয় পৃথিবীর উন্নততম দেশেও তা নেই। তিনি চান ফ্রিডম অব সেক্স, জরায়ুর স্বাধীনতা। যখন যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে সেক্স করায় বাঁধা থাকবে কেন? দুটি মন দুটি দেহ পরস্পরকে চাইতেই পারে, তাতে বাঁধা থাকতেই তার বিপত্তি হয়ে গেছে। কোন্ দেশের স্ত্রীরা স্বামীর বর্তমানে অন্যের সাথে সেক্স করতে পারে? পৃথিবীর সভ্য ইতিহাসে তা নেই। কিন্তু উনি তা-ই চান। বিকৃত রুচি আর কতোখানি হয়!
শাহিদ একটু থামে। মিমিও কোন কথা বলে না। একটু পরে সে বলে, বলুন না, আমি শুনছি।
আচ্ছা, আপনি কি জ্ঞদূরভাষিণীঞ্চ গল্পটা পড়েছেন?
ইম-মম--ম, না, পড়িনি। ওটা কার লেখা?
ঠিক মনে নেই, তবে খুব সম্ভবত সেলিনা হোসেনের, অথবা রাবেয়া খাতুনের।
গল্পটার ~েবশিষ্ট্য কী জানতে পারি?
নাহ্, থাক।
বলুন না প্লিজ।
দূরভাষিণী শব্দের অর্থটা বুঝতে পেরেছেন তো?
কিছুটা।
যেমন?
যে মেয়ে দূর থেকে কথা বলে।
ঠিক বলেছেন।
গল্পটার মেইন এট্রাকশন কী ছিল?
গল্পটাতে কোন এট্রাকশন ছিল না।
মানে? একদম নীরস একটা গল্প?
মোটেও নীরস নয়। এমন গল্প আমার জীবনে খুব কমই পড়েছি।
তাহলে বললেন যে কোন এট্রাকশনই নেই গল্পটায়?
ওটা ভুল করে বলেছি। যা বলতে চেয়েছিলাম তা বোঝাতে পারিনি।
আচ্ছা, এতো ভণিতা করছেন কেন, বলুনই না কী আছে গল্পটাতে?
আমি গল্পটা বলতে পারবো না। ওটা একটা করুণ গল্প। আমি ওরকম কিছু ভাবতেও চাই না।
টেলিফোনের অপর প্রান্তে মিমি নীরব থাকে, শাহিদও কোন কথা বলে না। কিছুক্ষণ পর মিমি নীরবতা ভেঙ্গে বলে, বলুন না, চুপ করে আছেন যে বড়?
নাহ্, স্টকে আর নেই। যা ছিল সব বলে ফেলেছি।
আপনি খুবই পড়েন, তাই না?
খুবই পড়ি না, তবে আমি প্রচুর বই কিনি। আমার ড্রইং রুম ভর্তি শুধু বই আর বই।
বই কি পাওয়া যাবে, পড়ার জন্য?
স্যরি, এটা যে পাবলিক লাইব্রেরি নয়।
ও-কে, মাফ করবেন, স্যরি।
আজকে বেরুবেন কোথাও?
আজ বা কালও না, পরশু।
কোথায় বেরুবেন?
ধানমন্ডিতে একটা বিটিক মেলা হবে। সেখানে যাবো।
পরশু কেন, কালই আসুন না?
হ্যাঁ, কালই আসবো, তাতে আপনার লাভ কী?
দেখা হবেনআপনার সাথে একটু ঘুরবো, এতোটুকুই।
কেন, আমার স্বামী নেই? আমি তাঁর সাথে হাত ধরাধরি করে ঘুরবো। আপনার সাথে কেন?
এতোখানি কড়া কথা বলতে পারলেন?
আপনি পারবেন আর আমি পারবো না?
আমি আবার কী কড়া কথা বললাম? কখন?
বই চাইতেই তো মুখের ওপর বলে দিলেন আপনার ঘর পাবলিক লাইব্রেরি না।
আই এ্যাম সো স্যরি মিমি, প্লিজ, আমি আমার কথাটা ফিরিয়ে নিচ্ছি। আমি বুঝতেই পারিনি যে কথাটা এতোখানি কঠিন হয়ে গেছে। আমি এখন বুঝতে পারছি।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আমি আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে বিরক্ত করলাম।
আমি বিরক্তবোধ করিনি।
অজস্র ধন্যবাদ। আমার বুকটা ভরে গেল।
কিছু মনে করবেন না, এ সময়ে আমার হাজব্যান্ড ফোন করে।
আচ্ছা রেখে দিচ্ছি। আরেকটা কথা বলি?
বলুন।
আজ কি আরেকবার ফোন করতে পারবো?
কেন ভাই, একটানা দেড় ঘন্টা কথা বললেন, সাধ মিটেনি?
আপনার কথা যতো শুনি ততোই আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।
কিন্তু স্যরি, আজ আর না।
একদিন কিন্তু রাত ১২ টায় ফোন করে বসবো।
প্লিজনপ্লিজনওটা করবেন না। রাত এগারটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি তো, আমি খুব ডিস্টার্বড ফিল করবো।
তাহলে কাল এমন সময়ে?
কাল আমি থাকবো না।
কোথায় যাবেন?
আমার হাজব্যান্ডের বাসায়।
ও-বাসায় টেলিফোন নেই?
হ্যাঁ আছে।
দেয়া যাবে?
ও গডনতামাম পৃথিবী মাথায় করে নিবে আমার শাশুড়ি।
আবার কবে ফিরবেন?
সামনে মাসের ২৬ তারিখে।
এতোদিন! আরো আগে আসা যায় না?
স্যরি জনাব।
আমি ২৬ তারিখ ঠিক পাঁচটায় ফোন করবো।
ঠিক আছে।
রাখি তাহলে। এতোক্ষণ সময় দেয়ার জন্য সত্যিই আপনার কাছে আমি কৃতঞ্চ।
ধন্যবাদ।
খোদা হাফেজ।
খোদা হাফেজ।
ও, ভালো কথা।
আরো?
আপনি আমাকে কখনো ফোন করেন না কেন?
ফোন করতে আমার খুব আলসেমি লাগে।
এমন কি আমার কাছেও?
যে-কারো কাছেই।
খুব কষ্ট~ পেলাম।
কেন?
এখনো আমি যে কারোর দলেই রয়ে গেলাম বলে।
মিমি খুব হাসতে থাকে। শাহিদ জিঞ্চাসা করে, আপনার কি মোবাইল আছে?
হুম।
নম্বর কতো?
না বাবা, ওটা দেয়া যাবে না।
কেন?
বেশির ভাগ সময়েই ওটা আমার হাজব্যান্ডের কাছে থাকে। সত্যি বলতে কী, ওটা আমার নয়, বলতে পারেন আমাদের মোবাইল।
আপনার হাজব্যান্ড বাসায় থাকাকালে মোবাইল বাজলে কে রিসিভ করে?
আমিই করি। তবেন
কী?
আমার জামাইটা একটু অন্য ধরণের। এক ফাঁকে দেখে নিবে কে ফোন করেছিল।
কখনো কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে না?
হ্যাঁ, ঘটে।
তখন কী করেন?
আমি কিছুই করি না।
আপনার স্বামী? কী করেন?
কেঁদে কুটে বাড়ি ঘর মাথায় তুলে নেয়।
আর আপনি তখন মনে মনে হাসতে থাকেন?
খু-উ-ব।
আপনি সত্যিই খুব নিষ্ঠুর।
আমার হাজব্যান্ড আসলে খুব গোমড়া। হাসি-ঠা-া কিছুই পছন্দ করে না। রুটিন মাফিক সকাল আটটায় বের হয়ে যায়, আসে রাত-আটটা ন-টা বাজলে। খাওয়া-দাওয়া সেরে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে নাক ডেকে ঘুমনএক ঘুমেই রাত পার।
আপনার জন্য সত্যিই আমার খুব আফসোস হয়।
কেন?
কারণ, আপনার ভিতরে একটা তসলিমা নাসরিন অহর্নিশি ফুলে ফেঁপে ফুঁসে উঠছে।
কীভাবে বুঝলেন?
ম্যাডাম, আমি তো কচি খোকা নই, দাদা হয়েছি।
মিমি হাসতে থাকে। শাহিদ বলে, তসলিমার একটা কবিতা আছেন
আমি আসলে কবিতা সবচাইতে কম পছন্দ করি।
আমিও কবিতা খুব পছন্দ করি না। তবে আমি কবিতাটা বলছি না, শুধু তার সারমর্মটা শুনুন।
ঠিক আছে বলুন।
গভীর রাত্রে রুদ্র বাসায় ফিরে, তসলিমার শরীরে তখন দাউ দাউ আগুন। হ্যালোন
শুনছি।
বহ্নিমান বুকের ওপর রুদ্র ঝাঁপিয়ে পড়ে, মাত্র দু-দন্ডনতারপর তৃপ্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে সে বুক থেকে নেমে গিয়ে পাশে বিভোরে ঘুমায়নতসলিমার বুকের আগুন বহুগুণ বেড়ে যায়, পাশে শায়িত নপুংশক স্বামীটি তা অনুভবও করতে পারে না।
একটু নীরবতা। শাহিদ বলে, বোঝাতে পেরেছি?
মিমি একটু টেনে টেনে বলে, হ্যাঁ, পেরেছেন। একটা কথা বলবো, আশা করি মাইন্ড করবেন না।
শাহিদ ব্যাপারটা বুঝতে পারে। বলে স্যরিন
আমাদের আলোচনার পরিধির একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকা উচিৎনআমি বলতে চাইছি যেনএসবন মানেনঐসব বিষয়ে আমি কারো সাথে কথা বলতে পছন্দ করি না। আমরা সর্বদাই আরেকটু সংযত এবং সচেতন থাকবো, কেমন?
আমি দুঃখিত, অত্যন্ত দুঃখিত।
তাহলে রাখি এখন?
ও, আসল কথাটা কিন্তু জানা হলো না।
পরে জানলে হয় না? অনেক সময় ধরে টেলিফোন এনগেজড তো, দেড় ঘন্টারও বেশি, দেখা যাবে যে আমার স্বামী ক্ষেপে ভূত হয়ে বাসায় চলে এসেছে।
তখন যদি দেখেন আপনি পরকীয়ায় মগ্নন
নাহ্, কে বলেছে আমি পরকীয়া করছি? আমি কি আপনার সাথে প্রেম করছি?
তাহলে?
আমি কিন্তু ফোন রেখে দিব।
স্যরি। আচ্ছা, যেটা জানতে চেয়েছিলাম, আপনার হাজব্যান্ড কী করেন?
গার্মেন্টস বিজনেস। ইসলামপুরে হোল-সেলার শপ আছে। মগবাজারেও একটা আছে।
ও, আপনি তো দেখছি কোটিপতির স্ত্রী।
না ভাই, এখানে আমার হাজব্যান্ড চাকর খাটে।
মানে?
বিজনেসের হর্তাকর্তা আমার শ্বশুর। আমার স্বামীসহ তাঁর চার ছেলে সার্বক্ষণিক সহায়তাকারী।
কিন্তু আপনার শ্বশুর তো আপনার হাজব্যান্ড এবং দেবর-ভাসুরদের জন্যই এসব করছেন।
করলে কী হবে, কারো কোন স্বাধীনতা আছে?
স্বাধীনতা নেই কেন?
দেখুন, আমার স্বামী হলো চার ভাই আর দুই বোনের মধ্যে সবচাইতে বোকা, কিন্তু পরিশ্রম করে সবচাইতে বেশি। বাড়িতেও, আমার অন্যান্য জা-রা পায়ের ওপর পা তুলে দিব্যি টিভি দেখে, আর বাসন-কোসন মাজা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না সবই আমি করি। কিন্তু আমার স্বামী কোনদিন একা আমার জন্য একটা শাড়ি আনতে পারে না। আনলে সবার জন্যই আনতে হবে, না আনলে নেই।
আপনার জন্য সত্যিই আমার দুঃখ হয়।
মিমির ঘরে দরজা খোলার শব্দ হয়। রিসিভার মুখের কাছ থেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে তার উদ্দেশে মৃদু ধমক দিয়ে বলে ওঠে, কী চাস? দরজা বন্ধ কর, যা আসছি। তারপর শাহিদের উদ্দেশে বলে, স্যরি, রাখতে হবে এখন।
আপনি একজন কড়া শাসক বোঝা যায়।
কীভাবে?
বুয়াকে যেভাবে হুকুম দিলেন।
বুয়া না, আমার খালাত বোন।
বেড়াতে এসেছে?
না, এ বাসায়ই থাকে।
ও।
আবারো দরজা খোলার শব্দ। মিমি তড়িঘড়ি বলে, স্যরি, রাখতে হবে।
কোন সমস্যা? এ কথা শেষ হবার আগেই ও-প্রান্তে মিমি রিসিভার নামিয়ে রাখে।


আজকের শুরুটা যেভাবে হয়েছিল শেষটা সে রকম হলো না। কেমন শেষ হয়েও হলো না শেষ, অন্তরে অতৃপ্তির রেশ। ভালোই, শাহিদ মনে মনে বলে, রবীন্দ্রনাথের কথাগুলোকে সে তার নিজের মতো করে ছন্দোবদ্ধ করে ফেললোনশেষ হয়েও হলো না শেষ, অন্তরে অতৃপ্তির রেশ।
অনেক দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলা হলো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কিছুই বলা হয়নি। মনে হচ্ছে মিমিকে আরো কতো কথা জিঞ্চাসা করার ছিল। কিন্তু সবচাইতে দরকারি কথা যে কোন্গুলো তাও সে বুঝতে পারছে না। মিমির কথাবার্তায় বেশ কিছু অসংলগ্নতা আছে বলে মনে হয়, কিন্তু ঠিক সেগুলোও সে চিহ্নিত করতে পারছে না।
কে এই মিমি? আসলে তার নাম কি মিমি? তাহলে তিশাটা কে? সে কি সত্যিই বিবাহিতা? তাহলে সব সময় এ বাসায়, মানে বাপের বাড়িতে পড়ে থাকে কেন? একবার সে বলেছিল সামনে জুলাইয়ে তার পরীক্ষা, মাষ্টার্স ফার্স্ট পার্ট। এখন বলছে জুলাইয়ে নয়, তার পরীক্ষা ২৬ নভেম্বরে, ইডেনে সোশ্যাল ষ্টাডিজে থার্ড ইয়ার অনার্স পড়ছে সে।
শাহিদ ভাবছে, মিমির টেলিফোনে বোধ হয় ডিসপ্লে বোর্ড আছে। ফোন করার সময় সেখানে নিশ্চয়ই তার নম্বরটা ভেসে ওঠে, তা না হলে যখন ফোন করার কথা বলা হলো সে তার ফোন নম্বর চাইতে পারতো।
একটা মোবাইল কেনা দরকার। সেটা টিএন্ডটি ইনকামিং হতে হবে। মিমিকে বলতে হবে, যখনই সে অবসরে থাকবে, যেখানেই সে থাক না কেন, তার মোবাইলে একটা মিসকল দিবে।
কিন্তু দিন যেতে চায় না। আগামী মাসের ২৬ তারিখ আসতে আরো বহুদিন। আজ কেবল এ মাসের ৬। পুরো এক মাস বিশ দিন বাকি।
অস্থির ~েধর্য্যের মধ্য দিয়ে পরের মাসের ২৫ তারিখ রাতে পৌঁছলো শাহিদ, কিন্তু উত্তেজনায় তার ভালো ঘুম হলো না।
২৬ তারিখ সকাল থেকেই তার বুক ছটফট করতে থাকলো। একবার সে ভাবলো সকাল বেলাতেই ফোন করলে কেমন হয়। আগে অবশ্য সকাল বেলায় ফোন কোনদিন করা হয়নি। পরে মনে হলো, ২৬ তারিখে তো এ বাসায় আসার কথা। নিশ্চয়ই এতো সকালে আসবে না। আবার তার মনে হলো, ২৬ তারিখে আসার কথা, দু-একদিন আগেও এসে থাকতে পারে; অবশ্য দু-একদিন পরে আসার সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে সে সর্বদা পজিটিভ দিকটারই আশাবাদী।
বুকে ধুকধুকানি নিয়ে সকাল আটটার দিকে সে ডায়াল করলো। রিং বেজে ওঠার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রচণ্ডভাবে তার বুক কাঁপতে থাকলো, কিন্তু মিমির ফোন এনগেজড। এতো সকালে ফোন এনগেজড? শাহিদের মন খারাপ হয় অকারণ সন্দেহেনতার মতোই অন্য আরেকজনের সাথেও তার প্রেমালাপ জমে ওঠেনি তো? কিন্তু পরের মুহূর্তেই তার সেই আশংকা দূর হয়, মিমি যে এ বাসায়ই আছে তা তো এখনো নিশ্চিত করে বলা যায় নানঅন্য কেউও ফোনে ব্যস্ত থাকতে পারে।
মিনিট পাঁচেক পর আবার সে ডায়াল করে এবং এবার লাইন ক্লিয়ার পাওয়া যায়, রিং যেতে থাকেনক্রি²ংক্রিংক্রিংনশাহিদের বুক ধপধপ ধপধপ করতে থাকে। রিং বাজে ক্রিংক্রিংক্রিংনসেই ধড়পড়ানি অবশ্য ধীরে ধীরে কমে আসে।
ক্রিংক্রিংক্রিং করে অবিরাম রিং বেজে চলছেনকিন্তু আশ্চর্য, কেউ ফোন তুলছে না। শাহিদ ভাবে, সকালে প্রথম ফোন পেয়ে হয়তো মিমির ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল, ফোন শেষে হয়তো বাথরুমে বা অন্য কোথাও গেছে, অতএব, আরেকটু পরে করাটাই সর্বশ্রেয়।
আবার মিনিট পাঁচেক পর সে ফোন করে। কিন্তু এবারও ফোন এনগেজড। খুব খটকা লাগে শাহিদের কাছে। মিমি নিজেই কি অন্য কোথাও ফোন করছে, নাকি অন্য কেউ তার কাছে ফোন করেছে? সে রীতিমতো ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠতে থাকে, হয় বিরক্তও।
আবার মিনিট পাঁচেকের বিরতিনআবার ফোননরিং যেতে থাকে, অনেকক্ষণ ধরে রিং বাজে, কিন্তু কেউ ধরে না। শাহিদের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে। খট করে রিসিভার নামিয়ে রাখে সে। তার সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরে গেছে। এক মিনিটের মাথায় সে পুনরায় ফোন করেনকিন্তু বিরক্তির আর শেষ থাকে নানআবারো ফোন এনগেজড।
শাহিদ শান্ত হয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেনএমন হচ্ছে কেন। তার ধারণা যেটা হলোনরিং বাজার শব্দ পেয়ে মিমি যখন হ্যান্ডসেট তোলে ততোক্ষণে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে শাহিদও ফোন রেখে দেয়। পরের বার যখন রিং করে তখনও হয়তো মিমি কানের কাছে রিসিভার রেখে ক্র্যাডলে খটখট শব্দ করে হ্যালো হ্যালো করতে থাকে। অবশ্য এমনও হতে পারে যে হ্যান্ডসেটটা ঠিকমতো ক্র্যাডলের ওপর বসানোই হয় না।
এমন ধাঁধার মধ্যে কিছুক্ষণ থাকার পর তার মনে হলো সে খুবই উত্তেজিত অবস্থায় আছে। সে খেয়াল করে দেখলো যে ফোন একবার এনগেজড, আবার ক্লিয়ার পাওয়া যায়, ব্যাপারটা ঠিক এ রকম নয়। সে এতোই উত্তেজিত অবস্থায় ছিল যে ডায়াল করার সময় মাঝে মাঝেই ফোন নম্বর ভুল করে ফেলতো, আর তখনই ওটা এনগেজড পাওয়া যেত। রং নম্বরেও যে লাইন ক্লিয়ার পাওয়া যায়নি, হয়তো তা-ও নয়, কিন্তু সে-লাইনগুলো হয়তো অব্যবহৃত ছিল।
সুস্থ মস্তিস্কে পরপর তিনবার ডায়াল করলো শাহিদ। অবশ্য প্রতিবারই লাইন ক্লিয়ার পাওয়া গেল। কিন্তু একবারও অপর প্রান্তে কেউ রিসিভার তুললো না।
দুপুরেও দু-তিনবার সে চেষ্টা করলো, কিন্তু নো রিপ্লাই।
পাঁচটার দিকে সে রিং করলো। দুবার রিং বাজার সাথে সাথেই রিসিভার তুলে মিমি বললো, হ্যালো স্লামালাইকুম। মুহূর্তে ঝিলিক দিয়ে শাহিদের সারা মন-প্রাণে একটা আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। নিশ্চয়ই বিকালের দিকে সে বাড়ি এসেছে, সারাদিন অযথাই ফোন করে সে হয়রান হয়েছে।
মিমি আবার বলে, হ্যালোনকিন্তু স্বরটা সামান্য একটু রুক্ষ শোনায় আর তখনই তার মনে হলো এ মিমি নয়, অন্য কেউ। মিমির কণ্ঠস্বরের সাথে সামান্য মিল থাকলেও এর গলা শুস্ক মরুভূমি, রসকসহীন। বুয়াদের কণ্ঠস্বর সচরাচর এমন হয়।
বুয়া আবারো টেনে টেনে বলে, হ্যালোনহ্যালোন। শাহিদ খানিকক্ষণ চিন্তা করে কথা বলবে কি বলবে না, তারপর সে মধুর সুরে জবাব দেয়, হ্যালো স্লামালাইকুম।
বুয়া অতি বিগলিত কণ্ঠে সালামের জবাব দেয়নওয়ালাইকুম আসসালাম।
শাহিদ কী বলবে ভেবে পায় না। সে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে সামান্য বিরতি নেয়, তারপর জিঞ্চাসা করে, রুমেল আছে?
রুমেল? রুমেল ক্যাডা বাবা?
স্যরি, এটা কি ৭৪১৭২৩৯?
না বাবা, এটা ৭৪১৭০৯৯। আপনি রং নাম্বারে ফোন করছেন।
স্যরি খালাম্মা, ডিস্টার্ব করলাম। বলেই শাহিদ হ্যান্ডসেট নামিয়ে রাখে। তার মেজাজটা ভীষণ তিরিক্ষি হতে থাকে। মিমি ২৬ তারিখে আসার কথাটা মিথ্যে বলেনি তো? সে অবশ্য আরো দু-একদিন পরও আসতে পারে।
কিন্তু শাহিদের মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপলো, অবশ্য একটু আশাও জাগলো। সারাদিন বাসায় কেউ ছিল না, বিকেলে অন্তত বুয়া ফোন তুলেছে, নিশ্চয়ই অন্য কেউ এখন বাসায় আছে, হয়তো মিমিও।
দ্বিতীয়বার সে ফোন করলো। এক ভদ্রলোক অতিশয় ভদ্রস্বরে উচ্চারণ করলেননহ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।
শাহিদ রিসিভারের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো বলে লাইন কেটে দেন। শাহিদ আশ্চর্য হয়, এ বাসায় এর আগে কখনো কোন পুরুষ লোক টেলিফোন রিসিভ করেনি। মিমি ছাড়া অন্য কেউও নয়। আজ অন্যরকম হলো, একবার বুয়া, আরেকবার এই ভদ্রলোক। ভদ্রলোক কে হতে পারেননতাঁর দরাজ গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে তাঁকে বয়স্কই মনে হচ্ছে। মিমির বাবাই হয়তো হবেন।
শাহিদ আরেকবার ফোন করলো। এবার বুয়ার কণ্ঠস্বর। সে স্লামালাইকুম বলে উত্তরের অপেক্ষায় থাকে, কিন্তু শাহিদ নির্বাক। বুয়া ঝাঁঝালো স্বরে বলে, হ্যালো, কথা কন না ক্যান? কিন্তু শাহিদ থতমত খায় এবং বিব্রতবোধ করে। টেলিফোন রেখে দিয়ে মন খারাপ করে ঝিম ধরে বসে থাকে। খামোখাই বুয়ার কাছ থেকে একটা ঝাড়ি শুনতে হলো। আগের বারের মতো সে ভদ্রভাবে সালাম দিয়ে বলতে পারতোন্স্যরি খালাম্মা, আমার টেলিফোনটা একটু ডিস্টার্ব করছে, ডায়াল করছি ৭৪১৭২৩৯-এ, কিন্তু দেখুন বার বার আপনার নম্বরেই চালে আসছে।
কিন্তু শাহিদ আজ কিছুতেই দমবে না, যা কিছু জানার বা বোঝার দরকার তা আজই বুঝে নিতে হবে, পরিস্থিতি যতো উত্তপ্ত ও তিক্তই হোক না কেন। যার সাথে কোনদিন দেখা হয়নি, যে আমার সত্যিকারের পরিচয় জানে না, ভবিষ্যতেও জানতে পারবে কিনা তা নিয়েও প্রচুর সন্দেহ আছেনতার সাথে ফোনে যতো তিক্ততাই হোক না কেন কিচ্ছু যায় আসে না।

মাগরিবের ঠিক পর পর শাহিদ আবার ফোন করলো। বুয়া এবার খুব নরম স্বরে বললো, হ্যালো, স্লামালাইকুম। কথা বলার আগে শাহিদ দ্রুত ভেবে নিয়ে স্থির করলো, বুয়াকে সে নিজের পরিচয় দিবে, ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করবে এটা তিশা নাকি মিমিদের বাসা, এ মেয়ের আসল পরিচয় কী, তার স্বামীর ঘর কোথায়? জবাব দিতে বিলম্ব হওয়ায় বুয়া আবার ডাকে, হ্যালো- মুহূর্তে শাহিদের সমস্ত মনপ্রাণ পুলকিত হয়ে ওঠে- এ বুয়া নয়, মিমি। সে উচ্ছ্বাস কোনমতে চেপে রেখে বলে ওঠে, হ্যালো স্লামালাইকুম, ভালো আছেন?
কিন্তু মিমির কণ্ঠস্বরে এক ফোঁটা আবেগ বা উচ্ছ্বাস নেই, এতোদিন পর কথা হলে যেরূপটা শাহিদ আশা করেছিল। মিমি অন্যন্ত নীরস স্বরে বলে, আপনি কি একটু পরে ফোন করতে পারবেন?
স্যরি, শাহিদ বলে, আপনাকে বোধ হয় অসময়ে বিরক্ত করলাম। ঘুমুচ্ছিলেন বুঝি?
না, তসবি পড়ছিলাম, মিমি বলে, নামাজ শেষে তসবি পড়ছি।
ওহ্‌ স্যরি। ঠিক আছে, পরে করবো। বলেই শাহিদ ফোন রেখে দেয়।
দারুণ ভালোলাগা- অনেক অপেক্ষার পর মিমিকে পাওয়া গেছে, যুগপৎ একটুখানিখতাশা- এতোদিন পর কথা হলো, অথচ মিমির কণ্ঠস্বরে কোনরূপ উচ্ছ্বাস নেই- শাহিদের মন আবার চঞ্চল ও বিষণ্ন হয়ে উঠতে থাকে। আগের বার কতো দীর্ঘ সময় ধরে কতো গভীর কথাই না হয়েছিল মিমির সাথে, তখন মনে হয়েছিল এই মিমিও তার জন্য উতলা হয়ে উঠবে। মিমি কি পাথর? এতো আবেগহীন হয় কী করে একটি মেয়ের মন? জীবনে এক দণ্ডের জন্যও যদি কোন একটা মেয়ের সঙ্গে গভীর দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যায়, সারাজীবন জ্বলজ্বল করে সেই সমৃতিখানি মনের গভীরে দূর-নক্ষত্রের মতো জ্বলতে থাকে। যে মেয়েটি একটুখানি মৃদু সিমত হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বাকি জীবনের জন্য আড়ালে চলে যায়, এমন কোন্‌ পুরুষ আছে যে ঐ হাসিমুখটির কথা ভুলে যেতে পারে? যে মেয়ের মিষ্টি কথাটি একবার কর্ণকুহরে ঢুকেছে, সারাটি জীবন তা কানের কাছে বাজতে থাকে সেই ভালোলাগা। কিন্তু মেয়েদের বেলায় এমনটা হয় না কেন? মেয়েদের মন কোন্‌ পাথরে তৈরি? মেয়েদের কি আদৌ মন আছে? আবেগ নেই? উচ্ছ্বাস নেই? এতো দীর্ঘ দিনের এতো কথার পরও কি মিমির মনে এতোটুকু দাগ পড়েনি? শাহিদের বুকে একটা কষ্ট জাগতে থাকে, সেই কষ্ট ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, বুক ছাপিয়ে, হৃদয় ছাপিয়ে।
শাহিদ অপমানিতবোধও করতে থাকলো। কারো কাছে ফোন করলে সে যদি বলে একটু পরে করলে ভালো হয়, তাতেই অপমানের চূড়ান্ত হয়। মিমি একটু পরেই ফোন করার কথা বলেছে। শাহিদ মনে মনে ভাবছে, একটু পরে কেন, ইহজীবনেও আর ফোন করা হবে না। পাথরেও পানি থাকে। আজ না হোক, কাল না হোক, বহুদিন পরে হলেও মিমির মনে একটুখানি দুঃখ জাগবে- কেউ একজন তাকে ফোন করবে বলেছিল, আজও করেনি।
এসব ভাবতে ভাবতে শাহিদের মন যখন বেদনায় ছেয়ে গেল, ঠিক এমন সময়েই সহসা তার মনের সকল দুঃখ সকল বেদনা উবে গেল। একেবারে ফুরফুরে মেজাজে শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠে বসে সে ভাবে- লাইফ ইজ ফুল অব ফান্‌স, ইট মাস্ট বি ফুল অব হিউমার্‌স।
টেলিফোনটা কাছে টেনে সে মিমির কাছে ফোন করে।
কিন্তু কী বিপত্তি, আবারো সেই ভদ্রলোক। শাহিদ নিঃশব্দে ফোন রেখে দেয়।
কিছুক্ষণের বিরতি নিয়ে আবার সে ফোন করে। ভদ্রলোক তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর গলায় টেনে টেনে বলেন, হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। শাহিদ এবারও নিঃশব্দে ফোন রেখে দেয়।
পরের বিরতিটা একটু বেশি সময়ের জন্য হয়।
কিন্তু এবার কেউ ফোন ধরে না। সে আবার ডায়াল করে, রিং যেতে থাকে।
কোন সালাম শুভেচ্ছা কুশল জিজ্ঞাসা নেই, রুক্ষ কর্কশ স্বরে বুয়া চেঁচিয়ে ওঠে, ঐ শুওরের বাচ্চা শুয়োর- তর মা-বোন নাইক্যা? দিন ভইর‌্যা এলা জ্বালাইতেছস কির লাই? কতা কস না ক্যান এলা, কতা ক, শুওরের বাচ্চা।
শাহিদ কথা বলে না। ভীষণ চেঁচামেচি শেষে দড়াম করে রিসিভার রেখে দেয় বুয়া।
আর নয়, শাহিদ পুনর্বার প্রতিজ্ঞা করে, কী এমন আশ্চর্য অলৌকিক মোহ আছে তিশা কিংবা মিমি নামক এক অনামিকা মেয়ের মধ্যে? জীবনে বহুবার এমন আসে, এসেছিল, হয়তো আসবে- সবকিছু মনে রাখা যায় না, মনে রাখতে নেই, সবকিছু মনে রাখা সম্ভবও নয়। সারা জীবনের অনেকগুলো সমৃতির মাঝে মধুর সমৃতিগুলোকেও মাঝে মাঝে ভুলে যেতে হয়, হবে, তা না হলে ওগুলো সমৃতির কুঠরে ঘনীভূত হয়ে তোলপাড় করে সারাটা জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। মিমির সাথে যা হলো, সব ভুলে যেতে হবে। সে এক দুঃখিনী প্রোষিতভর্তৃকা হতে পারে, সে কারো সুখী স্ত্রী হতে পারে, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তার গৃহে প্রবেশ করে সংসারে দাহ সৃষ্টি করে লাভ কী? যার মন পাওয়া গেল না, তার মন পাওয়ার চেষ্টা করাটাই বৃথা। Love at first impression is the purest love. প্রথম মিলনে যে প্রেমের সৃষ্টি সেটাই সবচাইতে নিখাদ প্রেম। প্রথম মিলনে মিমির মন পাওয়া যায়নি- পাওয়া যাবে না বাকি জীবনের সাধনায়ও। হতে পারে সে কোন এক অষ্টাদশী উর্বশী তরুণী, যার এক ফোঁটা রূপের ছটায় সারা পৃথিবী আলো ঝলমল করে উঠতে পারে- হোক না; যার মন পাথরে তৈরি, তার মন কেউ কখনো পায়নি, পায় না।


পর্ব-৪

নিষ্প্রাণ সময়, বিষাদময় দিননযেন ঠাঁয় স্থির। মাঝে মাঝে সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে বসে শাহিদ, চ্যাটরুমে ঢোকে, সেই পুরনো নামগুলো এখনো ওখানে ভেসে আছে, মেয়ে-নামগুলো মেয়ে কিনা বোঝার উপায় নেই। দু-একজনকে সে নক করে, কিন্তু সাড়া মেলে না। নিজেকে খুব খাটো মনে হয়, তার নামের প্রতি বোধ হয় কোন মেয়েরই কোন আকর্ষণ জাগে না। সেই জ্ঞআই-ফ্রেন্ডসঞ্চ ওয়েবসাইটটাতে গিয়েও নতুন নাম খোঁজে, ওখানে প্রতিদিন কতো নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে, কিন্তু কোনটাই হয়তো সত্যিকারের নাম নয়, যেটি সত্যিকারের সেটি হয়তো সত্যিকারের মানুষটির নয়, সত্যি নামের সত্যি মানুষের আড়ালে অন্য একটা মিথ্যে মানুষনসে মানুষটি একটি দুষ্টু মানুষ, মানুষের মন নিয়ে খেলা করাই তার কাজ।

বেশিদিন যেতে না যেতেই শাহিদের পুনর্বার প্রতিঞ্চাভঙ্গ হলো। কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে সে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে মিমিকে ফোন করলো। কারো প্রতীক্ষায় থাকলে যেভাবে হয় ঠিক সেভাবে রিসিভার তুলে মিমি বললো, হ্যালো স্লামালাইকুম।
শাহিদ সামান্য ঢোক গিলে বলে, ভালো আছেন?
মিমির কণ্ঠস্বর অলস হয়। ঘুম জড়ানো স্বরে সে টেনে টেনে বলে, হ্যাঁ।
আই এ্যাম স্যরি, এতো রাতে ফোন করার জন্য।
আপনি ঘুমাননি?
ঘুম আর আসে?
কেন, নিদ্রাহীনতায় পেয়েছে?
ঠিক তাই।
সিডাকসিন খাওয়া যায় না?
হুম্ যায়। একদিন একত্রে সবগুলো খাবোনপুরো এক পাতা।
বাব্বাহ্, খুব অভিমান দেখছি।
অভিমান? কার সাথে? সবার সাথে কি অভিমান করা যায়?
ঠিক আছে, না করা গেলে না করলেন।
আচ্ছা, শ্বশুর বাড়ি থেকে কবে ফিরেছেন?
মানে?
আপনি শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলেন না?
ও হ্যাঁ, যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যাওয়া হয়নি।
ও গড, আপনি শ্বশুর বাড়িতে যাবেন এ কথা বলে আমাকে দীর্ঘ এক যুগ কষ্টে রাখলেন? আপনি হাসছেন?
হাসবো না? এই দীর্ঘ এক যুগে কি আপনার একবারও ফোন করতে ইচ্ছে হয়নি?
প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে আমি আকুল হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু আপনার কথাটি সত্যি মনে করেই আমি ফোন করিনি, আপনি নেই এটা জেনেও আমি শূন্য বাড়িতে কার কাছে ফোন করবো?
স্যরি, আপনার দুর্ভাগ্য। ফোন করলে হয়তো আমাকে পেয়েও যেতে পারতেন।
কিন্তু যাননি কেন?
আমার মা খুবই অসুস্থ। বারডেমে ভর্তি ছিল।
কতো নম্বর রুমে?
কেন, সেখানে গিয়ে আমার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিবেন?
যদি নিই?
ও নো, তাহলে বলা যাবে না।
আচ্ছা, আমাকে এতো ভয় কেন?
নাহ্, ভয় পাবো কেন? আপনি কি বাঘ?
আসলে যে কারণে ফোন করেছি সেটা বলি?
ঠিক আছে, বলুন।
এতোদিন আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি।
আপনার ওপর কিন্তু আমার অনেক রাগ হয়েছিল।
জানতে পারি কি, কেন?
আপনি সেদিন এতো ঘন ঘন ফোন করলেন যে বাসার সবাই ক্ষেপে আগুন হয়ে গেল। মাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে, রাখা হয়েছে ঐ ঘরে, আর আপনি প্রতি মিনিট পরপর ফোন করতে থাকলেন, রিসিভার তুললে আপনি কথা বলেন না। কেউ না বুঝলেও আমি কিন্তু জানতাম এটা আপনি ছাড়া আর কেউ নয়। আপনার কি একটু সংযত হওয়া উচিত ছিল না?
আমি খুবই দুঃখিত এবং লজ্জিত, বড় অন্যায় হয়ে গেছে। আমার মনে হয় এটাই আপনার সাথে আমার শেষ কথা বলা।
অভিমান?
যার সাথে কথা বলি তার মনের তল পাই না। কী জন্য আর ফোন করবো?
ঠিক আছে, না করলেন।
একটা কথা বলি?
বলুন।
আপনি সব সময় শুধু আপনার জেদটাই বজায় রাখেন।
হ্যাঁন্সত্যি।
আপনার জ্ঞহ্যাঁ সত্যিঞ্চ, জ্ঞঠিক আছেঞ্চনএ ধরণের কথাগুলো আমার মনে খুবই কষ্ট দেয়।
আচ্ছা, সেজন্য আমি কী করতে পারি?
এই যে এই কথাটি বললেন, আপনি জানেন না আপনার এই কথাটি কতোখানি নির্মম।
মিমি কলকল শব্দে হাসতে থাকে। শাহিদ বলে, আপনার মনটা কখনো ভিজাতে পারলাম না।
আপনার মন ভিজেছে?
কে ভিজাবে?
কেউ নেই?
কখনো ভাবি আছে, আবার মনে হয় কেউ নেই।
মিমি হেসে কুটিকুটি হয়। বলে, আপনি কিন্তু একটা মস্ত ঠগ।
কেন?
আপনার স্ত্রীকে আপনি কখনো ভালোবাসেননি।
এই পৃথিবীতে যদি সত্যিকারেই কাউকে ভালোবেসে থাকি তাহলে সে আমার স্ত্রী।
মনে হয় না।
কেন?
তাহলে আমার কাছে ফোন করেন কেন?
আপনার সাথে কথা বলতে আমার ভীষণ ভালো লাগে!
কেন, আপনার স্ত্রীর কথা শুনতে আপনার ভালো লাগে না?
অবশ্যই লাগে।
তাহলে আগে যেটা বলেছি সেটাই ঠিক, আপনি একটা ঠগ।
শাহিদ কথা বলে না। মিমি জিঞ্চাসা করে, কী, খুব কষ্ট পেলেন বুঝি?
নাহ্, কষ্ট পাবো কেন? আমার কোন কষ্ট নেই।
এখন কি বাসা থেকে ফোন করছেন?
সব সময়ই।
আপনার বাসাটা কোন্ জায়গায়?
প্লিজ, এটা বলতে চাইছি না।
ঠিক আছে, একজ্যাক্ট পয়েন্ট না হোক, কাছাকাছি একটা জায়গার নাম বলুন।
মঙ্গলগ্রহ।
মিমি হো হো করে হেসে ওঠে। যাক, আমি খুশি হলাম এজন্য যে আপনার সম্পর্কে অন্তত একটা তথ্য আমাকে দিয়েছেন।
আমাকে খুশি করার জন্য যে চেষ্টা করা হয়েছে সেজন্য ধন্যবাদ।
আপনি মাঝে মাঝে ভাববাচ্যে কথা বলেন, বেশ মজাই লাগে।
ভাববাচ্য কাকে বলে?
ওহ্হো, আমি কি সামনে ব্যাকরণ বই নিয়ে বসে আছি?
বসে না থাকলেও আপনি ব্যাকরণে খুব ভালো, এটা সিওর।
খুব উল্টো হলো। ব্যাকরণ আর অংক হলো আমার কাছে সবচাইতে কঠিন আর বিরক্তিকর সাবজেক্টস্।
আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতি। আচ্ছা, একটা কাজ করেন না কেন?
কী কাজ?
আপনি লেখালেখি শুরু করেন।
আল্লাহ্, মাথায় বাঁশ ফাটালেও কলম দিয়ে একটা শব্দ বেরুবে না। কিন্তু আপনি লিখেন না কেন?
লিখতে মেধা লাগে, আমার সেটা নেই। তবে আমার কয়েকজন বন্ধু আছে, ওরা খুব লিখে।
তাঁদের নাম বলা যাবে?
ওদের নাম বলা আর না বলায় আমার কোন ক্ষতি হবে না। কারণ ওরা প্রত্যেকেই আমার কাছে প্রতিষ্ঠিত লেখক।
নাম?
ইমন মাহ্মুদ, শাহিদ কামালনওদের নাম কখনো শুনেছেন?
মিমি একটু বিরতি নেয়। শাহিদ বলে, ওরা অবশ্য উঠতি লেখক, দেশ জুড়ে এখনো ওদের নাম হয়নি।
হ্যাঁ, আমারও এক পরিচিত লেখক আছেন।
তাঁর নাম?
আবু সুফিয়ানের নাম শুনেছেন?
ইয়েস ইয়েস, শফিক রেহমানের মৌচাকে ঢিল ম্যাগাজিনে উনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন, কলাম লিখতেন। এরপর অবশ্য তাঁর অন্য কোন লেখা আমার পড়া হয়নি। উনি কি আপনার আত্মীয়?
না, আত্মীয় নয়। আমার ছোট চাচার সাথে কীভাবে যেন যোগাযোগ হয়েছিল। একবার আমাদের বাসায়ও এসেছিলেন।
আচ্ছা, আপনাকে যদি একটা কাজ করে দিতে বলি, করবেন?
বলুন।
আমার বন্ধুরা একটা সাহিত্য ম্যাগাজিন বের করে থাকে, আই থিংক ইউ নো হোয়াট এ লিটল ম্যাগাজিন ইজ। তো সেই পত্রিকার জন্য লেখার দরকার। আপনার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে কি কারো লেখালেখির অভ্যাস আছে? থাকলে তাঁদের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করে দিবেন।
মা্যগাজিনটার নাম কী?
তরুণ কণ্ঠ।
কখনো এর নাম শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না।
আপনি ঠিকই বলেছেন। মাত্র হাজার দু-আড়াই লোক হয়তো এ ম্যাগাজিনটার কথা জানে।
বাজারে পাওয়া যায়?
বাজারে পাওয়া যায় না। সম্পূর্ণ আমাদের নিজ খরচে ছাপি। ছাপা হওয়ার পর বিনামূল্যে লেখকদের কাছে কপি পাঠিয়ে দেয়া হয়, শুধু তাই নয়, বিতরণের জন্য অনেকগুলো সৌজন্য কপিও পাঠানো হয়।
আমি কি একটা কপি পেতে পারি?
এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হবে যদি আপনাকে এক কপি তরুণ কণ্ঠ পৌঁছে দিতে পারি।
কিন্তু কীভাবে পাবো?
কুরিয়ার করে আপনার বাসায় পাঠিয়ে দিব।
ও নো, খবরদার।
তাহলে নিজে এসে দিয়ে যাই?
ঠিকানা কোথায় পাবেন?
আপনার কাছ থেকে?
আমি তো আপনাকে ঠিকানা দিবই না।
তাহলে ইন্টারনেট থেকে নিব।
ওটা তো ভুয়া।
তাহলে জ্ঞও নোঞ্চ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন যে?
আমার মনে ছিল না যে আপনি আমার বাসার ঠিকানা জানেন না।
আরেকটা কাজ করি তাহলে?
কী রকম?
আপনার কি নীলক্ষেতে যাওয়া হয়?
হুঁউউম, খুব যাওয়া হয়। ওখানে আমার কলেজ না!
একটা বুকস্টলে যদি রেখে দিই?
আপনার বুকস্টল?
আমার কোন বুকস্টল নেই। ওটা এক পরিচিত লোকের স্টল।
বুকস্টলের নাম?
শাহানা বুক হাউস।
শাহানা কি আপনার স্ত্রীর নাম?
আরে ভাই, এতো সন্দেহ করছেন কেন, আমি বললাম না এটা আমার এক পরিচিত লোকের স্টল? শাহানা তার স্ত্রী নাকি মেয়ের নাম তা তো আমি জানি না।
স্যরি স্যরি। তারপর কী করবেন বলুন।
স্টলটা কিন্তু বাইরে খোলা ফুটপাতে। দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে একটা বটগাছ আছে, দেখেছেন না? সেই বটগাছটার গোড়ায়ই শাহানা বুক হাউজের স্টল। আপনি কবে আসবেন?
কী জানি, যেতেও পারি, আবার না-ও যেতে পারি।
ঠিক আছে, আপনি না যান, কিন্তু আমি রেখে আসবো। আপনি ওটা কোনদিন স্পর্শ না করুন, আমি ভাববো, ওটা আপনার হাতে ঠিকই পৌঁছে গেছে।
আচ্ছা আচ্ছা, ঘাট হয়েছে, আর অভিমানের দরকার নেই। আপনি কালই রেখে আসুন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই ওটা আমি নিয়ে আসবো।
আনবেন তো?
আনবো, তবে একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত?
আপনি যদি ওখানে লুকিয়ে থেকে আমাকে দেখতে চেষ্টা করেন তাহলে কিন্তু আমি যাবো না।
ও গড, আপনাকে দেখতে চাই বলেই তো এই ব্যবস্থা।
না বাবা, তাহলে আমি নেই।
ইশ, কী মেয়েরে বাবা! আচ্ছা ঠিক আছে, আমি থাকবো না। আপনি যাবেন তো?
গিয়ে কী বলবো?
কিছুই বলতে হবে না।
কী যে হাসির কথা বলেন! লোকটা জানবে কী করে আমি কী চাই?
হ্যাঁ, তাই তো! অলরাহট, আপনি বলবেন, তরুণ কণ্ঠ আছে কিনা।
দাম কতো?
দাম যা-ই হোক, আপনার জন্য থাকবে সৌজন্য কপি।
ধন্যবাদ।
না গেলে কিন্তু আমার সারা জীবনের কসম।
ও-কে।
আমি জানবো কী করে আপনি গেলেন কিনা?
জানার কোন প্রয়োজন আছে?
ওহ্, আপনি সব সময় উল্টো স্রোতে চলেন।
তাই?
আমি কিন্তু কালই ফোন করবো।
কেন?
আপনি গেলেন কিনা তা জানার জন্য।
যেতে কিন্তু আমার কয়েকদিন দেরিও হতে পারে।
ঠিক আছে, আপনি ওটা আনুন বা না আনুন, যুগ যুগ ধরে ওটা ওখানে পড়ে থাক, আমি কোনদিনই ফেরত আনবো না। আপনি কোনদিন না আসুন, আমি যুগ যুগ ধরে ওখানে উদয়াস্ত প্রতীক্ষায় থাকবো, আপনি আসবেন এই মনে করে।
বলতে বলতে শাহিদের কণ্ঠস্বর ঘন ও ভারি হয়ে ওঠে। টেলিফোনের অপর প্রান্তে মিমির হাসির শব্দ শোনা যায়।
কিছুক্ষণের নীরবতা, তারপর মিমি বলে, কী হলো, কোন কথা নেই কেন?
জানি না।
বাব্বাহ্, অভিমানে ফেটে পড়ছেন দেখছি!
অভিমান করবো কেন? অভিমান তার সাথেই চলে যার ওপর অধিকার আছে।
আমার ওপর আপনার কোন অধিকার নেই?
আপনি বুকে হাত রেখে বলুন, আপনার ওপর কতোখানি অধিকার আমাকে দিয়েছেন?
অধিকার কখনো দেয়া যায় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়।
হ্যাঁ, আপনিই বলুন, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি আর কী কী করতে পারি?
সেটা তো আমি আর বলে দিতে পারি না।
আপনি যদি চান আপনার জন্য আমি আগুনে ঝাঁপ দিব। আপনি যদি চান, আপনার জন্য সাত সমুদ্র তের নদী সাঁতরে আপনার কাছে আসবো। আপনি চাইলেই একদিন হঠাৎ আপনার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলবো, মিমিকে আমি ভালোবাসি, মিমিকে আমি বিয়ে করতে চাই।
মিমির সশব্দ হাসি ভেসে আসে। হাসতে হাসতেই সে বলে, আমার স্বামী আপনাকে এমনি এমনিই ছেড়ে দিবে ভাবছেন?
আপনার স্বামী সম্পর্কে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না।
ভালোই। খুউব ভালো লাগছে, শান্তি, শান্তিনআমার জন্য কেউ একজন দিওয়ানা মাস্তানা হয়েছে এর চেয়ে বড় সুখ আর কী হতে পারে?
ঠা-া করছেন?
না, ঠা-া করবো কেন? পঞ্চান্ন বছরের এক উঠতি তরুণ বিশ বছরের এক বিবাহিতা ঝানু বুড়ির প্রেমে পড়েছে, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? ঠা-া করবো কেন?
কে বলেছে আমার বয়স পঞ্চান্ন?
আপনি বলেছিলেন।
ওটা মিথ্যে ছিল।
তাহলে সত্যি কোন্টা?
আপনার কাছে সত্যি বলেই লাভ কী?
তাহলে কি সবই এতোদিন মিথ্যে বলেছেন?
সবই মিথ্যে হবে কেন?
আপনার স্ত্রী, ছেলে, ছেলে-বউ, নাতিনএসব সত্যি নয়?
হ্যাঁ, সত্যি। তো?
আপনি কী করে ভাবলেন যে সতীনের সংসার করার জন্য এক বৃদ্ধের ঘরে যাবো?
সতীনের ঘরে কি কখনো সুখের সংসার হয় না?
পৃথিবীর ইতিহাসে আজও সম্ভব হয়নি।
আসলে পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের কারোরই সঠিক ধারণা নেই।
একটা সত্য কথা বলুন এবার।
হ্যাঁ, বলুন।
আপনি বিয়ে করেছেন কবে?
সেটা জানা কি খুবই জরুরি?
অবশ্যই জরুরি।
আপনি আন্দাজ করুন।
আপনার বয়স কি সত্যিই পঞ্চান্ন নয়?
সেটাও আন্দাজ করুন।
অলরাইট, অন্তত এটা বলুন আপনি কতো সনে এস.এস.সি. পাশ করেছেন।
আমার মনে হয় এটা বলতে আমার কোন অসুবিধে নেই। ১৯৭৩ সনে এস.এস.সি. পাশ করেছি।
১৯৭৩?
চমকে গেলেন যে?
আপনি এস.এস.সি পাশ করেছেন ১৯৭৩ সনে, আর আমার জন্মই হয়েছে তারও প্রায় এক যুগ পরে। এনিওয়ে, একটা সত্য বলার জন্য ধন্যবাদ।
আপনার জন্মসনটা হিসাব করছি।
খুবই সোজা। ১৯৮৩-তে আমার জন্ম। আসছে ১৬ নভেম্বরে বিশ বছর পূর্ণ হবে।
আপনি খুবই ইনোসেন্ট।
কীভাবে বুঝলেন?
কোন মেয়ে তার জন্ম বৃত্তান্তের হিসাব এতোখানি পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষভাবে কাউকে বলে না।
কিন্তু আপনি তার সম্পূর্ণ উল্টো।
কেন, আমি কি বলিনি যে ১৯৭৩ সসে আমি এস.এস.সি. পাশ করেছি?
তাহলে আপনার বয়স কতো হলো?
আন্দাজ করুন।
১৯৭৩ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ত্রিশ বছর, এস.এস.সি. যদি হয় পনর বছর বয়সে, ত্রিশ যোগ পনর মোট বয়স আপনার হয় ৪৫ বছর। ৪৫ বৎসর বয়সে কি স্কুল-গোয়িং নাতির দাদা হওয়া সম্ভব?
একটু ভুল শুধরে দিই। আমাদের সেই সময়ে বিশ বছরের নিচে খুব কম ছেলেই এস.এস.সি. দিয়েছে। আর আমি বিয়েটা করে ফেলেছিলাম একটু আর্লি এইজে।
তারপরও তো পঞ্চাশের ওপরে আপনার বয়স কিছুতেই হতে পারে না।
হ্যাঁ, পঞ্চাশ বছরে কি দাদা হওয়া যায় না?
কিন্তু সেই নাতির বয়স আট থেকে দশ বছর হলেই খটকা লাগে।
কিছুদিন আগে খবর হয়েছিল, বত্রিশ বছর বয়সী এক যুবক দাদা হয়েছেন। পৃথিবীর কণিষ্ঠতম দাদা।
ওহ্হোনআপনিই কি সেই কণিষ্ঠতম দাদা? কংগ্রাচুলেশন্স, দ্য ইয়াঙ্গেষ্ট গ্রান্ড-ফাদার অব দ্য ওয়ার্ল্ড।
আমি নিশ্চয়ই কণিষ্ঠতম দাদা নই। এটা একটা উদাহরণ দিলাম। ৩২ বছর বয়সে দাদা হওয়া সম্ভব হলে ৪২ বছরের কথা তো বলাই বাহুল্য। পঞ্চাশ বছর বয়সে সেই নাতির বয়স আট, যে তার দাদুর হাত ধরে স্কুলে যায়।
বাহ্, আপনি খুব সুন্দর গল্প সাজাতে পারেন। বলুন তো আপনি গল্প-টল্প লিখেন কিনা?
আমি আগেই বলেছি, ওসব লিখা-টিখার অভ্যাস আমার নেই। কিন্তু আপনার এ ধারণাটা হলো কীভাবে যে আমি গল্প বানাতে পারি?
আপনি নিজেই বলেছেন যে আপনার বয়সের ব্যাপারটা মিথ্যে ছিল, এখন আবার নিজেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রং চং মাখিয়ে রসিয়ে রসিয়ে সেটাকে সত্য বানাবার চেষ্টা করছেন।
আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি বলেছিলাম যে আমার বয়স পঞ্চান্ন না-ও হতে পারে। এখন তো আপনাকে ক্যালকুলেশন করেই দেখালাম যে আমার বয়স পঞ্চাশ হলেও এ বয়সে আট বছর বয়সী এক নাতির দাদা হওয়া অসম্ভব নয়।
আপনি রাতে খুব কম ঘুমান, তাই না?
স্যরি, আপনার ঘুমের ব্যাঘাত করছি। এখন কি তাহলে রাখবো?
মিমি হেসে দিয়ে বলে, আমি কি সেটা বলেছি?
তাহলে?
বলতে চাইছি যে যার মাথায় এতো বুদ্ধি তার তো রাতে ঘুম হওয়ার কথা নয়।
শুধু আপনিই নন, আমার কম বুদ্ধি নিয়ে আমার বন্ধু-বান্ধব সবাই আমাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করে।
স্যরি, আমি তো একটা ফান করলাম, তাতেই এতোখানি সিরিয়াস হয়ে গেলেন?
স্যরি, আমার বুদ্ধি কম তো, তাই ফান ধরতে পারি না।
মিমি হিহিহি করে হাসতে থাকে। শাহিদ বলে, আমার স্ত্রীর সাথে কিন্তু আমি উল্টো আচরণ করি। তার সাথে ফান করতে থাকি, সে আস্তে আস্তে ফুঁসতে থাকে, তার বউরা তা দেখে কিটকিট করে হাসতে থাকে, তাতে সে আরো রেগে মেগে জ্বলে ওঠে।
আপনি একটা চমৎকার মানুষ। ব- অন্য রকম।
আমার বুকটা ভরে গেল।
তাহলে কি এখন রাখা যায়, জনাব?
ইয়েস ম্যাডাম, বাই অল মিন্স।
এই খবরদার, আমি আবারো ওয়ার্নিং দিয়ে রাখছি, নীলক্ষেতে বুকস্টলে যদি আপনাকে দেখি তাহলে কিন্তু রক্ষা নেই।
জো হুকুম, মহারাণী।
তাহলে ভালো থাকুন।
আপনিও ভালো থাকুন।
আবার কথা হবে। খোদা হাফিজ।
আল্লাহ্ হাফিজ।


পর্ব-৫

পরদিন দুপুরেই অন্যসব কাজ ফেলে শাহিদ নীলক্ষেতের শাহানা বুক হাউজে মিমির জন্য তরুণ কণ্ঠ রাখতে গেল। এক মিমির জন্য চার কপি তরুণ কণ্ঠ একটা বড় খামের ভিতরে ঢুকিয়ে স্টাপলার দিয়ে মুখ আটকে দিল। খামের ওপরে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখলো জ্ঞতিশা, কিংবা মিমি, কিংবা যার নাম আজও জানা গেল না, তার জন্যঞ্চ। কিন্তু কোথাও তার নিজের নাম লিখলো না।
আরো একটা কাজ সে করেছে। একটা কবিতা লিখেছে, নাম দিয়েছে জ্ঞদূরভাষিণীঞ্চ। জ্ঞদূরভাষিণীঞ্চ ছোটগল্পটা কার লেখা তা সে জানতে পারেনি, পারলে কবিতাটা আরো সমৃদ্ধ হতো। প্রথমবার কবিতা লিখে পরদিন আবার পড়তে হয়, তখন অন্য রকম লাগে, শ্রুতিকটু শব্দগুলো তখন কানে ধরা পড়ে, ওগুলো বদলে নতুন শব্দ যোগ করতে হয়। ছন্দপতনও কানের কাছে বিশ্রীভাবে বেজে ওঠে, ওগুলো ঠিক করা হয়। এভাবে প্রতিদিনই একটু একটু করে পরিমার্জন করা হয়, একটা মনের মতো শব্দ যা প্রথম দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি, একদিন তা-ও এসে অনায়াসে কবিতায় বসে পড়ে। রেজাউদ্দিন স্টালিন একবার বাংলাদেশ টেলিভিশনের এক সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, একটা যথোপযুক্ত শব্দের জন্য কবিকে বছরের পর বছর, যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করতে হতে পারে, শাহিদ সেই অনুষ্ঠানটি দেখেছিল। সে শুধু কবিতার ক্ষেত্রেই নয়, গদ্য রচনার জন্যও তাই করে। কিন্তু জ্ঞদূরভাষিণীঞ্চ কবিতাটা সে এক বসায় লিখে ফেলেছে, তারপর আর একটা শব্দেরও পরিবর্তন করা হয়নি। কঠিন প্রেমে পড়লে মুখ দিয়ে যা বের হয় তার সবই কবিতা হয়, কলমে যা লিখা হয় তার সবই হয়ে ওঠে কালোত্তীর্ণ অমর কবিতা। শাহিদ ভাবে, সে কি তাহলে সত্যিই কঠিন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে? জ্ঞএখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়ঞ্চ। হেলাল হাফিজের এই কবিতার বিরুদ্ধে তার মন সোচ্চার হয়ে ওঠে, ভুল, সবই ভুল, এখন যৌবন যার প্রেমে পড়বার তার শ্রেষ্ঠ সময়। যৌবনে প্রেমে না পড়লে কি বৃদ্ধ বয়সে প্রেমে পড়বে মানুষ? এসব ভাবতে ভাবতেই সে মনে মনে হেসে ওঠে, মনটা ব- ছেলে-মানুষের মতো ভাবছে আজকাল।
কম্পিউটার কম্পোজ করে অফসেট কাগজে লেজার প্রিন্ট বের করেছে। কবিতার বিষয়-বস্তু ও ভাষার মাধুর্যের চেয়ে ঝকঝকে ছাপার অক্ষর অবশ্য তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
অতি মোলায়েম হাতে চার ভাঁজ করে কবিতাটা তরুণ কণ্ঠের ভিতরে গুঁজে দেয়া হয়েছে, পৃষ্ঠা খুললেই ভীষণ ফর্সা কবিতার কাগজটা মিমির চোখে পড়বে, প্রথমে ওটা দেখেই তার মনে হবে একটা চিঠি। কিন্তু ভাঁজ খুলে দেখবে চিঠি নয়, অন্য কিছু, একটা ঝলমলে কবিতা, কিন্তু কী করুণ!


দূরভাষিণী

দূরভাষিণী, আপনি বলেছিলেন অন্য সবার চেয়ে
আমি নাকি অন্যরকম, একেবারে অন্যরকম। আমি বহুবার আপনার কাছে
জানতে চেয়েছিলাম আমার সেই অন্যরকম ~েবশিষ্ট্যের কথা।
আপনি টেলিফোনের প্রান্তে হাসিতে গলে পড়ে
বারংবার সেই একই কথার ফুলঝুরি ছড়ালেননআপনি ব- অন্যরকম।

আমি জানি না দূরভাষিণী কী আপনার সত্যিকারের নাম যে নামে
আপনাকে ডেকে ডেকে প্রাণান্ত হতে কেবলই সাধ হয়। যে মেয়ে তার নাম বলে না অথবা গোপন করে তাকে সবাই জ্ঞঅনামিকাঞ্চই ডাকে,
আমি ডাকিন্দূরভাষিণী।
আমি বলেছিলাম, অনামিকা, আপনি কি রাবেয়া খাতুনের জ্ঞদূরভাষিণীঞ্চ পড়েছেন, সেই অদ্ভুত মিষ্টি কণ্ঠস্বরের করুণ মেয়েটির বেদনার কাহিনীটি কি
আপনার জানা আছে? অবশ্য রাবেয়া খাতুন না হয়ে সেলিনা হোসেন বা অন্য যে কেউ-ই হতে পারেন সে কাহিনীর জননী।
সেলিনা হোসেন কিংবা রাবেয়া খাতুন কিংবা অন্য কেউনজ্ঞদূরভাষিণীঞ্চ
আপনি পড়েননিনখুব নরম করে জানিয়েছিলেন।
আমি বলেছিলাম, জ্ঞঅনামিকাঞ্চ ব- সাধারণ অনামিকাদের নাম, আপনার নামটি বরং জ্ঞদূরভাষিণীঞ্চই থাক।

দূরভাষিণী, আমি জানি না কিংবা হয়তো সুনিশ্চিত জানি, আপনিই
সেই দূরভাষিণী, সারাটা ক্ষণ আপনার টেলিফোনের প্রতীক্ষায় আমি কান পেতে থাকি, প্রতিদিন কতো কথা হয়ন
টিএসসি কিংবা পাবলিক লাইব্রেরি, জাতীয় যাদুঘরে কবিতাসন্ধ্যা, বাংলা একাডেমিতে বইমেলায় যাবার কথা বললেই
আলসেমিতে আপনার অবশ কণ্ঠস্বরনআপনি কি সেই দূরভাষিণী, করুণ সুমিষ্টকণ্ঠী দুঃখিনী বালিকাটি নন?

দূরভাষিণী, আপনি জানেন না আপনার কণ্ঠস্বরে কী অপূর্ব মাদকতা আছে, যা সারাক্ষণ আমার কানে বাজে, অবিরাম কানে বাজে,
প্রতিধ্বনির মতো সেই কণ্ঠস্বর অবিরাম কানে বাজে,
হাঁটতে চলতে কানে বাজে,
খেতে বসি, তখনো কানে বাজে,
বেসিনের সামনে যাই, দাঁত ব্রাশ করি, আয়নায় চেহারা দেখি,
সেই কণ্ঠস্বর কানে বাজে, যখন গোসল করি, তখনো কানে বাজে,
শুতে যাই, ঘুমের ঘোরে আপনার মধুর কণ্ঠস্বর শুনে চমকে জেগে ওঠি,
শুনি কানের কাছে সেই কণ্ঠস্বরনঅবিরাম বেজে চলে।

দূরভাষিণী, আমি জানি, আপনার দেখা কোনদিনই পাবার নয়, আপনিই রাবেয়া খাতুনের সেই দূরভাষিণী।
একদিন হঠাৎ ফোন করে দেখবো ও-প্রান্তে নেই আপনি, অন্য কণ্ঠস্বর,
আমি তৎক্ষণাৎ ক্র্যাডল চেপে লাইন কেটে দেবো,
তারপরদিন আবার ফোন করবো, সেদিনও আপনি নেই,
এরপর প্রতিদিননপ্রতিদিন অস্থির ফোন করা হবে, আপনি নেই,
ক্লান্ত একদিন থেমে যাবো হয়তো বা, দিনের পর দিন এভাবেই ব্যর্থ বিষণ্ন সময় চলে যাবে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর,
যুগ পেরিয়ে. যাবে, একদিন আপনার ফোন নম্বরটিও কীভাবে ভুল হয়ে যাবে, কিংবা বদলে যাবে, কিংবা বদলে যাবেন আপনি নিজেই।

সেই দুঃসহ বুকফাটা সময়ের বেদনায় কেবলই আমার অন্তর বিদীর্ণ হয়।

কবির নাম লিখা হয়নি যদিও, কিন্তু মিমি নিশ্চিত বুঝতে পারবে এটি কে লিখেছে। প্রথম অর্ধেক সে পড়বে আর হাসবে, কতো কী যে বানিয়ে বানিয়ে কবিতায় লিখা হয়েছে, এতোসব বিষয়ে কি ফোনে তার সাথে কথা হয়েছে? সেটাই শাহিদের কৃতিত্ব, তার স্বপ্নচারী কবি-মন এসব ভাবে আর লিখে। কিন্তু শেষের দিকে এসে পড়তে পড়তে মিমির মন বেদনায় ভরে উঠবে, কী এক নিদারুণ বিচ্ছেদের সুর!
শাহানা বুক হাউজের মামুনের সাথে আগে তার দু-একবার দেখা ও কথা হয়েছে, এর কাছ থেকে একত্রে অনেকগুলো বই কিনেছিল বলেই এতোটুকু সখ্যতা হয়েছিল। তার হাতে খামটি সঁপে দিয়ে শাহিদ বললো, এই খামটা একটু আপনার স্টলে রাখতে হবে। আমার দাদা তাঁর এক ছাত্রীর জন্য পাঠিয়েছেন।
আজই নিতে আসবে?
আজই আসার কথা। তবে দাদা বলেছেন যে সপ্তাহ খানেক দেরিও হতে পারে, এমনকি এক মাস বা আরো বেশিও দেরি হতে পারে।
আসলে কিছু বলতে হবে?
কিছু বলতে হবে না। দাদা বলেছেন যে উনি এসে তরুণ কণ্ঠের কথা জিঞ্চাসা করবেন। আপনি তখন এই পুরো খামটাই তার হাতে তুলে দিবেন। ঠিক আছে?
কোন অসুবিধা নেই স্যার।
আপনার চা খাওয়ার জন্য দাদা আপনার জন্য একশোটা টাকাও পাঠিয়েছেন।
টাকা দিয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন স্যার? আপনার দাদাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলবেন। ম্যাডাম কি শুধু তরুণ কণ্ঠই নিতে আসবেন, নাকি অন্য বই-টইও কিছু নিবেন?
ও হ্যাঁ, দাদা বলেছিলেন জ্ঞকঞ্চ বইটা কিনে এই খামের মধ্যেই ভরে দিতে।
স্যার, অরিজিন্যাল জ্ঞকঞ্চ কিন্তু নাই। ডুপ্লিকেটটা দিলে হবে তো?
হবে হবে, কোন অসুবিধা নেই।
মামুন কী বুঝে একটু মুচকি হাসলো, তবে তা শাহিদের নজরে পড়লো না। সে জিঞ্চাসা করে, স্যার, আপনার নামটা যেন কী?
শাহিদ বলে, আমার নাম বললে তো মহিলা চিনতে পারবেন না। আমার দাদার নাম বলবেন। বলবেন, আবিদ করিম সাহেব পাঠিয়েছেন। আমার দাদার নাম আবিদ করিম। মহিলা অবশ্য দাদাকে তাঁর ডাকনামেই চিনেন। দাদার ডাকনাম হলো রনি।
ও-কে বস।
আচ্ছা, জ্ঞকঞ্চ বইটার দাম কতো?
স্যার, অরিজিন্যালটার দাম ২৫০ টাকা। নকলটার দাম ১০০, তবে আপনার জন্য মাত্র ষাট টাকা।
শাহিদ পকেট থেকে দুটি একশো টাকার নোট বের করে মামুনের হাতে তুলে দেয়। বলে, বইয়ের দাম ষাট টাকা, বাকি একশো চল্লিশ আপনার চা-নাস্তা খাওয়ার জন্য।
কিন্তু মামুন প্রথমে তা নিতে রাজি হলো না, অনেক জবরদস্তির পর অবশ্য রাখতে বাধ্য হলো।
শাহানা বুক হাউজ থেকে কয়েক কদম দূরে গিয়ে সে আবার ফিরে আসে। একটা সুন্দরী মেয়ে মামুনের স্টলের সামনে এসে দাঁড়ালো। সে বইয়ের স্তুপের একদিক থেকে আরেক দিকে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। শাহিদ মনে মনে বলে, এ মেয়ে তরুণ কণ্ঠ খুঁজছে না তো? মেয়েটা অবশ্য কোন কথাবার্তা না বলেই চলে গেল।
শাহিদকে পুনর্বার দেখতে পেয়ে মামুন একগাল হাসি দিল।
একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, শাহিদ বলে, খামের মুখটা খুলে তার ভিতরে জ্ঞকঞ্চ বইটা ঢুকিয়ে দিন।
আপনার খামটা স্যার খুবই ছোট। আরেক কাজ করি, আপনার খামটা এবং জ্ঞকঞ্চ বইটা একত্রে আরেকটা বড় খামের মধ্যে রেখে দেই।
ভেরি গুড আইডিয়া। এটা তো আমার মাথায়ই ঢোকেনি। তাই করুন, তাই করুন।
ও-কে বস।
আসি তাহলে, খোদা হাফিজ।
খোদা হাফিজ, বস।
চলে যাওয়ার সময় সে আশেপাশের স্টলের দিকে তাকালো। তার মনের মধ্যে সূক্ষ্ম আশা জাগেনএমন কাকতাল হয়তো ঘটেও যেতে পারেনমিমি এখনই চলে এসেছেনসে ইডেন কলেজের ছাত্রী, ক্লাস শেষে চলে আসাটাই স্বাভাবিক, হ্যাঁ, কলেজ এখন খোলানএর চেয়ে মধুর কাকতালীয় ঘটনা আর হয় না।
আবারো আরেকটা কথা শাহিদের মনে পড়ে যায়। এমনও তো হতে পারে যে শাহিদের আসার আগেই মিমি সকালবেলা এসে এক প্রস্ত ঘুরে গেছেনহয়তো ক্লাসে ঢোকার আগেই সে ম্যাগাজিনটা নিতে এসেছিল, এমন তো হতেই পারে। মামুনকে অবশ্য এই কথাটা জিঞ্চসা করা হয়নি।
স্যরি, আরেকবার ডিস্টার্ব করতে এলাম, স্টলের সামনে ফিরে এসে মামুনের উদ্দেশে সে বলে। কিন্তু মামুন তখন অন্য এক খদ্দেরের সাথে দরাদরিতে ব্যস্ত ছিল এবং স্বভাবতই শুনতে পেল না।
শাহিদ গলার স্বর আরেকটু উঁচু করে বলে, মামুন সাহেব, জিঞ্চাসা করতে ভুলে গিয়েছিলাম, সকালবেলা কি তরুণ কণ্ঠের খোঁজে কোন মহিলা বা মেয়ে এসেছিল?
মামুনের মুখে সামান্য একটু বিরক্তির ছায়া। সে বলে, স্যার, সকালবেলা থেকে তো বহুত মেয়ে মানুষই আসলো গেল, আপনি কার কথা বলছেন?
শাহিদ থতমত খায়। বলে, আই মিন, কেউ এসে তরুণ কণ্ঠের কথা জিঞ্চাসা করেছিল কিনা তাই জানতে চাইছি।
স্যরি বস। তরুণ কণ্ঠ করুণ কণ্ঠ চাইবার জন্য কেউ আসেনি।
শাহিদের মুখটা ভীষণ কালো হয়ে যায়। সে অত্যন্ত বিব্রত ও বিমর্ষ ভাবে স্টল ছেড়ে চলে যেতে থাকে। চলে যেতে যেতে সে ভাবেনপ্রেমে পড়লে বোধ হয় এমনই ঞ্চান বুদ্ধি লোপ পায়।
এরূপ বোকামির জন্য শাহিদের মন বেশ অনুশোচনায় ভরে উঠলো। তিন চারদিন পর্যন্ত এই ঘটনাটি তার মনের মধ্যে আগুন জ্বালতে থাকলো।
তবে তার মনের মধ্যে একটা অকারণ পুলকও সারাক্ষণ লেগে থাকলো। আগের চেয়ে অনেক কাছাকাছি চলে আসা গেছেনমিমির মনটা যে কিছুটা গলেছে তা সহজেই অনুমেয়, সে নিজে নীলক্ষেতে গিয়ে তরুণ কণ্ঠ আনতে রাজি হয়েছে।
মিমি তরুণ কণ্ঠ আনলো কিনা তা জানার জন্য শাহিদ খুব চঞ্চল হয়ে উঠলো। তরুণ কণ্ঠ মিমির হাতে পৌঁছলে তার কী লাভ হবে এ সম্পর্কে অবশ্য শাহিদ খুব একটা স্বচ্ছ নয়। তবু তার মনে হলোন্দুজনের মুখোমুখি হবার এটা একটা প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।
মিমির হাতে তরুণ কণ্ঠ পৌঁছেছে কিনা তা জানার জন্য শাহিদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। প্রথমতঃ মিমিকে ফোন করে তা জেনে নেয়া যায়। কিন্তু মিমি যদি বলে এখনো আনা হয়নি তা শুনে শাহিদের খুব খারাপ লাগবে। অন্য কাজটি যা সে করতে পারে তা হলো নীলক্ষেতে শাহানা বুক হাউজে গিয়ে জিঞ্চাসা করা। কিন্তু সেখানেও যদি একই জবাব পাওয়া যায় তবে লজ্জায় ও অপমানে তার মরে যাওয়া ছাড়া কোন পথ থাকবে না।
মিমি বলেছিল সে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই তরুণ কণ্ঠ নিয়ে যাবে। অসীম ~েধর্য্য নিয়ে শাহিদ এক সপ্তাহ পার করলো। তারপর একদিন বিকেলে মিমিকে ফোন করলো।
হ্যালো স্লামালাইকুম। মিমির মিষ্টি কণ্ঠস্বর।
স্লামালাইকুম। ভালো আছেন?
জ্বি।
আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে আমি আমার কথাটা রাখতে পারিনি।
কী কথা?
আমি আসলে গত সপ্তাহটা খুবই ব্যস্ত ছিলাম, তাই নীলক্ষেতে যেতে পারিনি। তরুণ কণ্ঠ না পেয়ে খুব রাগ করেছেন?
মিমি সামান্য একটু সময় নিয়ে বলে, আপনি যাননি, অথচ দেখুন আমি সেদিন পুরো বিকেল জুড়ে নীলক্ষেতের মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আই এ্যাম সো স্যরি, কিন্তু আপনি কি শাহানা বুক হাউজে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, কিন্তু ওটা তো ঐদিন বন্ধ ছিল।
কিন্তু শাহানা বুক হাউজ তো কোনদিন বন্ধ থাকে না।
ঐ দিন ছিল। পাশের লোক বললো যে দোকানের লোক দেশের বাড়ি গেছে। দুদিন পর ফিরবে।
আমার এখন প্রচুর আফসোস হচ্ছে। আচ্ছা, আজ কি ফ্রি আছেন?
কেন?
বিকেলে নীলক্ষেতে আসুন না একবার।
হ্যাঁ, সম্ভাবনা একটু আছে বইকি, বলা যায় না, আসতেও পারি।
আসবেন তো?
কিন্তু না-ও আসতে পারি।
আসুন না প্লিজ।
আসলেই যে আপনার সাথে দেখা হবে তা-ও কিন্তু নয়।
কেন?
আপনার সাথে দেখা করে আমার কী লাভ?
দেখা করুনই না একবার।
আচ্ছা, আপনি যেন কী করেন?
নীলক্ষেত আসুন, সবই বলবো।
কথা দিতে পারছি না।
ও, আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি।
কী কথা?
আমি একটা মোবাইল কিনেছি।
খুব ভালো।
আমার নম্বরটা রাখবেন?
বলুন।
০১৭৫০২৯৫৩০। লিখেছেন?
হুম।
একটা রিকোয়েষ্ট করি?
করুন।
যখনই অবসরে থাকবেন, প্রতিদিন অন্তত একবার আমার মোবাইলে একটা মিসকল দিবেন। দিবেন তো?
মিসকল কেন দিব?
প্রতিদিন অন্তত এক মিনিটের জন্য হলেও আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে চাই। আপনার মিসকল পেয়ে আমি রিটার্ন কল করবো।
আমি চেষ্টা করবো।
এ্যাট এনি টাইম।
ও-কে।
আমি কিন্তু সারাক্ষণ আপনার মিসকলের প্রতীক্ষায় থাকবো।
ও-কে।
ল্যান্ড ফোন থেকে যখন তখন ফোন করে মিমিকে পাওয়া যায় না। এটাই সবচাইতে ড~ত্তম হয় যে মিমি যখন অবসর থাকবে তখন সে মোবাইলে মিসকল দিবে। সঙ্গে সঙ্গে শাহিদ রিটার্ন কল করে কথা বলবে।

মিমির মিসকল আসবে এই আশায় শাহিদ বহু অস্থির সময় কাটালো। কিন্তু পরবর্তী সপ্তাহ খানেকে কোন মিসকল এলো না। শাহিদের সন্দেহ হলো, মিমি নিশ্চয়ই মোবাইল নম্বরটা ঠিকমতো লিখে রাখেনি, কিংবা ভুলে গেছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অবশ্য সহজেই মিমিকে ল্যান্ডফোনে পাওয়া যাচ্ছে, মিমির বাবা কিংবা বাসার বুয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। কাজেই মিমির মিসকলের জন্য অপেক্ষায় থাকাটাও হয় অর্থহীন। কিন্তু তারপরও যদি একটা মিসকল আসে তার মনে হবে নিশ্চয়ই মিমি এখন তার কথা ভাবে, দু-দণ্ড অবসরে ফোনে কথা বলার জন্য সে-ও উন্মনা হয়, তারও মন আনচান করে।
মিমিকে এবার সব কিছু খুলে বলতে হবে। প্রেমে পড়লে এতো মিথ্যে বলতে হয় এটা মনে করে শাহিদের খুবই অনুশোচনা হতে লাগলো। কৌতুক করেও কখনো মিথ্যে বলতে নেইনএ হাদিসটি সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার চেষ্টা করেছে এতোদিন। কিন্তু মিমির সাথে ফোনে আলাপ হবার পর থেকেই সে-কথা সে বেমালুম ভুলে গেছে।
সে কী কারণে যে এতোদিন ধরে এতোগুলো মিথ্যে বলেছে তাও একটা রহস্য বটে। সে মনে করার চেষ্টা করে, তার একদম স্থির মনে আছে, মিমির কাছে যেদিন সে প্রথম ফোন করেছিল তার আগে পর্যন্ত সে এক বিন্দুও ভাবেনি যে তাকে কোনদিন এতোগুলো মিথ্যে বলতে হবে। মিমি যখন সহসা বলে উঠেছিল সে বিবাহিতা, তখন সে-ও তাকে ঝোঁকের মাথায় বলেছিল তারও স্ত্রী-পুত্র, পুত্রবধূ আছে। সে মিমিকে প্রাণপনে বোঝাতে চেয়েছিল যে স্রেফ বন্ধুত্বের খাতিরেই কিংবা শুধু বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্যই সে নিজে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ বিবাহিত পুরুষ হয়েও তার সাথে ফোনে এতো আলাপ করেছিল। মিমি যে বড় একটা বিপদের মধ্যে পড়েছিল এটা সে নিশ্চিত বুঝতে পেরেছিল, তাকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধারেরও একটা গোপন সদিচ্ছা তার মনের মধ্যে ছিল। কিন্তু মিমি তার এই পরোপকারী মনোভাবের বিষয়টা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিল কিনা সে সম্পর্কে শাহিদ আজও নিশ্চিত হতে পারেনি।
মিমিকে সব সত্যই খুলে বলতে হবে, শাহিদ ভাবে, সে একজন যুবক, তার আছে নিজস্ব পেশা ও যোগ্যতা; এ-ছাড়াও তার আরো একটা পরিচয় আছে, যা সে সচরাচর বলে বেড়াতে অপছন্দ করে, কারণ সে খুবই প্রচার-বিমুখ। সত্রী, পুত্র, পুত্র-বধূদ্বয়, নাতি-নাতনিনএসব তার স্বপ্নের কথানতার আগামী সংসারটি এমন সুখময় হবে। মা, ছোটবোনকে নিয়ে মিরপুরে নিজস্ব একতলা ছোট এক বাসায় তারা থাকে, সেখানে একদিন মিমিকে নিয়ে আসতে হবে, তার মা মিমিকে দেখবেন, পুত্রবধূটি ভয়ানক সুন্দরী, মহল্লার ডজন ডজন যুবক এর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, ব্যর্থ হয়ে ইন্টারনেটে তার নামে যতোসব আজেবাজে তথ্য সম্বলিত বায়োডাটা ছেপে দিচ্ছে। কিন্তু আশংকা এখন একটাই, মিমি যদি সত্যি সত্যিই বিবাহিতা হয়ে থাকে, তখন কী হবে?
মিমি যে বিবাহিতা নয় তার বেশ কয়েকটি জলজ্যান্ত প্রমাণ মেলে। সবচেয়ে বড় প্রমাণনমিমি আগাগোড়া অনেক মিথ্যে বলে এসেছে, সত্যিকারেই তার নাম তিশা, মিমি নয়, তার শ্বশুরের যে বিরাট গার্মেন্টস শপের কথা বলা হয়েছে সেটা সত্যি হলে শ্বশুর বাড়ি খুবই ধনী পরিবার, ধনী পরিবারের বউটি যে দিনের পর দিন বাপের বাড়ি পড়ে থাকবে তার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। সে সত্যিকারেই ইডেন কলেজে ছাত্রী, থার্ড ইয়ার সোশ্যাল ষ্টাডিস অনার্সে পড়ছে সে, তার আগে যেসব পরীক্ষার কথা সে বলেছিল তা বানোয়াট।
এরূপ অনেক বিশ্লেষণের পর শাহিদ নিশ্চিত হলো মিমি কিংবা তিশা নামের মেয়েটি এখনো অবিবাহিতা, কুমারী।
এরপরের বার যেদিন মিমিকে ফোন করা হলো, কেউ ফোন ধরলো না। চার পাঁচবার রিং করেও কেবল নো রিপ্লাই পাওয়া যেতে থাকলো। মিমি কি তাহলে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল নাকি, যদিও তার বিয়ে হওয়া নিয়ে এখনো যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তারপরের দিন, পরের দিন, এভাবে পরপর পাঁচদিন ফোন করেও মিমিকে পাওয়া গেল না। শাহিদের মনটা খারাপ হয়ে যায়, মিমি আসলেই বিবাহিতা নারী। আসলেই সে বাপের বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু এ বাসায় কি ফোন ধরার জন্য অন্য কেউ নেই?


প্রায় মাস দুয়েক পর শাহানা বুক হাউজের মামুনের সাথে দেখা করতে গেল শাহিদ, যদিই বা তিশা কিংবা মিমি নামের সেই রহস্যময়ী নারী কিংবা যুবতী তার দেয়া তরুণ কণ্ঠ নিয়ে গিয়ে থাকে। তরুণ কণ্ঠটি মিমির হাতে পৌঁছলে সে নিশ্চয়ই শাহিদের সাথে যোগাযোগ করবার জন্য অস্থির হয়ে উঠবে। ওখানে সম্পাদকীয় দফতরে প্রধান সম্পাদকের নামটি দেয়া আছে আবিদ করিম, মিমি যদি খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে তাহলে দেখবে আবিদ করিম নামটার নিচে একটা ফোন নম্বর দেয়া আছে, তার নিচে আরো একটা মোবাইল নম্বর লেখা আছেন০১৭৫০২৯৫৩০, মিমিকে এই মোবাইলে ফোন করতে বলেছিল সে। মিমির সন্দেহ হবে, কে এই আবিদ করিম লোকটা? সে-ই কি রনি নয়? ওই ফোন নম্বরটি থেকেই কি এতোদিন ধরে কেউ একজন তার সাথে কথা বলছে না? তারপর ভিতরে সুন্দর ভাঁজ করা কাগজটা খুলবে, ঝলমলে অক্ষরের একটা নিদারুণ করুণ কবিতা তার সামনে প্রতিভাত হবে। কবিতা সে ভালোবাসে না, তারপরও রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সে এটি পড়বে, কারণ এটি তাকে নিয়ে লেখা, পড়তে পড়তে কবির প্রতি এক প্রচণ্ড আকর্ষণবোধ জন্ম নিবে তার মনের ভিতরে। কে এই কবি? নিশ্চয়ই রনি ওরফে আবিদ করিম নামের এ লোকটা, কিংবা টগবগে যুবকটা। এভাবেই হয়তো নতুন করে পরিচয়ের একটা সূত্র পাওয়া যাবে। তাতে যে ঠিক কতোখানি লাভ হবে তা-ও শাহিদের মাথায় পুরোপুরি ঢুকছে না।
তবে তরুণ কণ্ঠ এখনো মিমির হাতে গিয়ে পৌঁছেনি এ ব্যাপারে সে কিছুটা নিশ্চিত। পত্রিকা নিয়ে আসার জন্য যে মেয়ের এতোখানি আগ্রহ থাকবে, সে অবশ্যই ওটি নিজের কাছে নিয়ে আসার পর শাহিদকে ফোন করবেইনতাকে নিয়ে লেখা একটা কবিতার জন্য মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া ও কৃতঞ্চতা জানানোর জন্য।
শাহিদের ধারণাই সত্যি, মিমি তরুণ কণ্ঠ নেয়নি। তার বুকের আবেগ এখন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছেনযদিও তার মনের মধ্যে এখনো একটা সূক্ষ্ম আশা জেগে আছে যে একদিন মিমি এসে মামুনের কাছে তরুণ কণ্ঠ চাইবে, শাহিদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিবে, অতঃপর তাদের ঝিমিয়ে যাওয়া পরিচয় ও পরিণয় নতুন মাত্রা পাবে। প্রেম গাঢ়তর হবে। তবে সে মনে মনে এ কথাটি শোনার জন্য প্রস্তুতই ছিল যে কেউ তরুণ কণ্ঠের খোঁজ করেনি।
মামুনের কাছ থেকে সে তরুণ কণ্ঠের খামটা ফেরত চাইল না। পড়ে থাকনযুগ যুগ ধরে এখানেই পড়ে থাক, সে নিজ হাতে এগুলো আর কক্ষণোই স্পর্শ করবে না। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও না।
নীলক্ষেতের মোড় থেকে খুব অলস পায়ে ভার্সিটি এলাকার দিকে হাঁটতে থাকে শাহিদ। বাম দিকে হোটেলের সারি, ডানদিকে খোলা রাস্তায় বইয়ের স্তুপ। রঙিন কপোতীরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে প্রিয় বইয়ের সন্ধান করে। শাহিদ অপরাপর সময়ে এ পথে হাঁটতো, আর দণ্ডায়মান ললনাদেরকে এক নজর দেখে চোখের তৃষ্ণা মেটাতো। আজ তার কাছে সব কিছুই বিতৃষ্ণনপানসে, বিস্বাদময় মনে হয়। সোজা সামনের দিকে মাথা নিচু করে সে হাঁটছে। অন্য কোনদিকে চোখ নেই, মন নেই।
জ্ঞকঞ্চ বইটা আছে?
হঠাৎ শাহিদ চমকে দাঁড়ায়। ঠিক তার এক কদম পেছনে ডানপাশের বইয়ের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে যে মেয়েটি জ্ঞকঞ্চ বইটি চাইল, সেটি তার বহুদিনের পরিচিত কণ্ঠস্বরনসে মিমি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সে মিমির কাছাকাছি চলে আসে। এটা কি বসন্তকাল? মিমি একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে। তার চুলগুলো বাঁধা। শাড়ির রঙের মতো তার ঘাড়খানি কাঁচা হলুদ বাটার মতো ফুটে আছে।
মিমির প্রায় কানের কাছে গিয়ে শাহিদ খুব নরম স্বরে বলে ওঠে, এক্সকিউজ মিনমিমি চকিতে ফিরে তাকায় ও মুখোমুখি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সমস্ত বিসময় ও আনন্দ দুজনের চোখে মুখে বিজলির মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
শাম্মী! শাহিদের কণ্ঠস্বরে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের উচ্ছ্বাস।
শাহিদ! তুই এখানে! আবেগে শাম্মীর মুখে কথা সরে না।
দুজনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বললো। তারপর ঢুকলো পাশের এক হোটেলে। সেই কতো বছর আগের কথা, এক স্কুলে পড়েছে। শাহিদ এরপর গ্রাম থেকে ঢাকায় চলে এলো, কিন্তু শাম্মী কোথায় লেখাপড়া করেছে তা সে জানে না। স্কুলে পড়ার সময় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মতোই এদের মধ্যে অতি সাধারণ কথাবার্তা হতো। কিন্তু এতোদিন পর হঠাৎ দেখা হওয়ায় মনে হচ্ছে যেন কতোদিন ধরে এদের মধ্যে বিশেষ হৃদ্যতা ছিল, আজ তা প্রবল আবেগে প্রকাশ পেয়ে গেছে।
শাহিদ কৌতুক করে বলে, তুই যে কতো সুন্দর হয়েছিস তা কি তুই জানিস?
যাহ্! শাম্মী কৃত্রিম ভর্ৎসনা করে বলে, আমি আবার সুন্দর হতে যাবো কেন? আমি হলাম কালো হাঁড়ির মতো কালো। বলেই মিষ্টি করে হাসতে থাকে শাম্মী। সেই হাসির ছটায় ওর সর্বাঙ্গ খলখল করতে থাকে। শাহিদের মনও ব্যাকুল হয়ে ওঠেনসেই কণ্ঠস্বর, মিমির মতো ঠিক সেরকম করে শাম্মী বলেনআমি হলাম কালো হাঁড়ির মতো কালোনমেয়েদের কণ্ঠস্বরে এমন অদ্ভুত মিল হয় কী করে? শাহিদ আশ্চর্য হয়ে ভাবে।
তোর কথা বল, শুনি। শাম্মী বলে।
আমি আর কী বলবো, তোকে দেখে দেখেই আমি পাগল হচ্ছি। তুই কথা বল, আমি শুনি আর তোকে প্রাণ ভরে দেখি।
ইশ্! শাম্মীর চোখে মুখে মিষ্টি হাসির ঝিলিক, সে বলে, আমার জীবনটা ধন্য হয়ে গেল রে।
তার চেয়েও বেশি ধন্য হলাম আমি, তোর মতো একটা অসাধারণ সুন্দরীর সাথে দ্বিতীয় জীবনে দেখা হলো বলে।
খুব চাপা মারছিস কিন্তু।
চাপা মারবো কেন? তুই যে একটা জ্বলন্ত আগুন এটা কে না বলবে?
তুইও বলিস? শাম্মী খুব গভীরভাবে শাহিদের দিকে তাকায়।
বিশ্বাস হয় না?
আগে তো কখনো বলিসনি।
আগে কখনো বলবার সুযোগ দিয়েছিস?
সুযোগ কি কেউ কাউকে করে দেয়? এটা নিজেকেই করে নিতে হয়। হয় না? বলে আরো গাঢ়ভাবে সে শাহিদের দিকে তাকায়। সেই চাহনিতে যে আকর্ষণ, সৌন্দর্য, মমতা ও ভালোবাসা মিশে আছে তা মুহূর্তে শাহিদের বুকের গহীনে গিয়ে একটা প্রচণ্ড আঘাত হানে।
তোর কথা আগে কখনো ভাবিনি তা নয়। তবে এতোটা গভীর করে ভাবিনি এটা সত্যি। কিন্তু আমার কথা কি কেউ কখনো ভেবেছিল? শাহিদ জিঞ্চাসা করে।
কেউ কি কখনো তা বোঝার চেষ্টা করেছিল?
আশ্চর্য, আমি কিন্তু কোনদিন ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।
তোর কি একটা ঘটনার কথা মনে আছে?
কোন্টা?
মনে নেই, কে যেন তোর কবিতার খাতাটা দেখতে চেয়েছিল?
সত্যিই মনে নেই। কে দেখতে চেয়েছিল? তুই?
থাক।
বল না?
আরেকটা দিনের কথা বলবো?
বল।
স্কুলের গাছ থেকে তোকে আম পেড়ে দিতে বলেছিলাম।
দিইনি?
প্রচুর আম পেড়েছিলি।
তো?
সেগুলো ক্লাসের সবগুলো মেয়েকে বিলিয়ে দিলি।
আর তোকেই দিইনি?
আমাকে দিলেই বা আমি নিব কেন?
কেন? নিসনি কেন?
আমি বললাম আম পাড়তে, তুই আম পাড়লিও, সবার মধ্যে সেই আম বিলিয়ে সবার মন জয় করবি, আমি তা মেনে নিব ভাবছিস?
শাম্মী, তুই বিশ্বাস কর, আমার এই মুহূর্তে আম-টাম পাড়ার কথা কিচ্ছুই মনে পড়ছে না। তবে সত্যি সত্যিই যদি আম পেড়ে থাকি তবে সব মেয়ের মন পাবার জন্য নিশ্চয়ই আমি আম বিলিয়ে দিইনি। এমন হয়তো হয়ে থাকতে পারে যে আমগুলো পেড়ে এনে মেয়েদের সামনে টেবিলের ওপর ফেলে রাখলাম, মেয়েরা কাড়াকাড়ি করে ওগুলো নিয়ে নিল।
আমার কথায় আম পেড়ে এনে আমাকে না দিয়ে তা সবার মধ্যে বিলিয়ে দিলি, আমাকে তাহলে কতোটুকু গুরুত্ব দিলি?
গুরুত্ব তো তোকেই দেয়া হলো। তা না হলে আমি আমই বা পাড়বো কেন? আমাকে দেখেছিস না মেয়েদের সামনে কতোখানি লাজুক লতার মতো মাথা নিচু করে থাকতাম?
তাই বুঝি?
তাই নয় তো কী? আমাকে কখনো মেয়েদের সাথে গল্প করতে দেখেছিস? মেয়েদের দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিস? অথচ অন্য ছেলেরা কতো সহজভাবে তোদের সাথে মিশতো, হাসি-ঠা-া করতো। আমার খুব আফসোস হতো ওভাবে পারতাম না বলে।
কিন্তু মেয়েরা তোর সম্পর্কে অন্যরকম ভাবতো।
কী ভাবতো?
ভাবতো তুই ব- অহংকারী।
তাই? আমাকে তুই হাসালি। কিন্তু আমার মতো নিরেট নিরহংকারী ছেলেটাকে বিনাদোষে এরূপ অহংকারী ভাববার কারণটা কী ছিল?
তুই আসলেই খুব অহংকারী ছিলি। ক্লাসের ফার্স্ট বয়, তোর মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলে চৌদ্দগ্রামে নেই; গল্প, কবিতা, গান লিখিস, এ্যাথলেটিক্সে চ্যাম্পিয়ন, বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন, এমন কী ছিল যাতে তুই নেই? তোর কাছে মনে হতে স্কুলের একটা মেয়েও তোর সমকক্ষ নয়।
শাহিদ জোরে হেসে উঠে বলে, কী অদ্ভুত কথা রে! কী আশ্চর্য!
তোর সাথে কথা বলার আগে মেয়েরা খুব ভেবে-চিন্তে নিত, কী বলতে কী বলে ফেলে। আমি সবচাইতে বেশি নার্ভাস হয়ে পড়তাম, তোর ধমক খেয়ে আবার হার্টফেইল করি কিনা।
আমি কি এতোখানিই টেরর ছিলাম?
তোর প্রতি মেয়েদের আকর্ষণের মূল কারণ ছিল এটাই।
কিন্তু মেয়েদের সাথে কেউ কখনো ধমকে কথা বলে?
তুই খুউব বলতি। একদিন টিফিনের সময় রাকা তোকে বাজার থেকে সিঙ্গারা এনে দিতে বলেছিল। সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচটা ছেলে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো, তুই কিন্তু পাত্তাই দিলি না।
শাম্মী, আমার কিন্তু এসবের এখন কিচ্ছুই মনে পড়ছে না।
তোর তো মনে না থাকারই কথা। আমাদের কারো কথা কখনো ভেবেছিস যে মনে পড়বে?
এটা কিন্তু মিলাতে পারছি না। তুই আম পাড়তে বললি, আমি আম পেড়ে দিলাম, অথচ রাকা সিঙ্গারা আনতে বললো আমি ওকে পাত্তাই দিলাম না। এটা যদি সত্যও হয়, তবু কিন্তু তোর খুশি হবারই কথা।
কেন?
অন্তত তোর কথাটি আমি শুনেছিলাম বলে।
এখন বললে কি শুনবি? বলে গাঢ় চোখে সে তাকায়। একটি হাত তার নেমে এসে টেবিলের ওপর রাখা শাহিদের এক হাতের ওপর আলতোভাবে পড়ে। শাহিদ হারিয়ে যেতে থাকে।
এবার তোর কথা বল। শাহিদ বলে।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হাত সরিয়ে নেয় শাম্মী। বলে, আমার কথাই তো এতোক্ষণ বললাম। এবার তোর কথা বল।
তুই এখন কোথায় থাকিস?
আমাদের বাসায়ই থাকি। দু-মাস পর কানাডা চলে যাচ্ছি।
কানাডা? কানাডা কেন?
ওখানে আমার হাজব্যান্ড থাকে।
ওওওন। শাহিদের বুক থেকে ক্ষীণ একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো বের হয়।
তুই কি এতোদিন কানাডা ছিলি? শাহিদ জিঞ্চাসা করে।
নাহ্, দেশেই ছিলাম। ও অনেক আগেই কানাডার সিটিজেনশীপ পেয়ে গেছে। আমারও শীঘ্রই হয়ে যাবে।
তাহলে তো আর দেশে আসবি না। কারো কথা মনে থাকবে?
শাম্মীর মুখটা ম্লান হয়ে আসে। বলে, সবাইকে ভুলে থাকতে পারাটাই ভালো। এই যে এতোদিন পর তোর সাথে দেখা হলো, এটা না হলেই বরং ভালো ছিল রে। এখন খুব খারাপ লাগবে। খুবই খারাপ লাগবে।
খারাপ লাগবে কেন, কতো ভালো আছিস! স্বামী আছে, তোর আছে সুন্দর সংসার।
সংসার! পাঁচ বছরের বিয়ে-জীবন, সংসার কী জিনিস তাই বুঝতে পারলাম না।
তোর বাচ্চা-কাচ্চা কই?
আকাশের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে শাম্মী বলে, ওখানে।
আর দেরি করিস না।
যাহ্! লজ্জায় শাম্মীর মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে।
একটু নীরবতার পর লাজরাঙা মৃদু ম্লান হাসিতে শাম্মী বলে, একটা বেবির জন্য আমার মনটা পাগল হয়ে আছে রে! বলতে বলতে ওর কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে ওঠে। দুজনের কথা বন্ধ হয়ে যায়, কী এক নিদারুণ করুণতায় ছেয়ে যায় ওদের মন।
নীরবতা ভেঙ্গে শাহিদ বলে, তোর মোবাইল নম্বর কতো?
০১৭২০৮০৬৬৭।
আমি সেইভ করে নিচ্ছি। আমার মোবাইল নম্বর ০১৭৫০২৯৫৩০।
একটা মিসকল দে তো।
শাম্মীর মোবাইলে মিসকল দেয়া হয়। শাম্মী ওর মোবাইলে শাহিদের নম্বরটা সেইভ করে রাখে।

বাসায় ফেরত আসার পর থেকেই শাহিদ ছটফট করতে থাকলো। মানুষের মন কতো বিচিত্র! কিছুক্ষণ আগেও যে-মন জুড়ে ছিল তিশা কিংবা মিমি নামের কোন এক মেয়ে, সে এখন প্রায় ভুলে যাওয়া নাম।
বিষম গভীর রাত, অন্তরে দারুণ ঝড়। যখন একান্ত অস্থির হয়ে উঠলো, ঠিক সেই সময়ে শাহিদ মোবাইলে ফোন করলো।
হ্যালো স্লামালাইকুম। একদম মিমির কণ্ঠস্বর। আবার সেই মিমির কথা মনে পড়ে যায়। শাহিদ পাগল হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে বলে, তুই কি ঘুমিয়েছিস, শাম্মী?
আমি ঘুমাইনি। তুই? আবেশ-জড়ানো স্বরে শাম্মী বলে।
ঘুমাসনি কেন?
আমি জানি না। শাম্মীর কণ্ঠস্বরেও অস্থিরতা।
আমি এখন কী করবো রে, শাম্মী? তোকে ছাড়া বোধ হয় আমি বাঁচবো না।
আমাকে তুই মেরে ফেলতে পারবি?
আমি তোকেই চাই। খুব গভীরভাবে চাই।
আমাকে কেন এতো পাগল করছিস, লক্ষ্মীটি? তোর কী লাভ তাতে?
আমার এই সুদীর্ঘ শুকনো জীবনে আমি কোন নারীর ঘ্রাণ পাইনি। তোর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে তুই ছাড়া আমার অন্য কোন পথ নেই।
আমারও তাই মনে হচ্ছে।
শাম্মী, কী হবে তোর কানাডায় গিয়ে?
আমি জানি না। আমি কি যেতে চাই?
পারবি না তুই ওসব কানাডা-ফানাডা বাদ দিতে?
আমি তোকে চাই। আমি জানি না আমার কী হয়েছে।
তুই ওসব বাদ দে। চলে আয়।
আমি ওসব চাই না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না রে।
আমার বাসায় চলে আয়। আসবি?
আসবো।
কবে আসবি?
যখন আসতে বলিস।
এখন?
হুঁম, মনে মনে।
ঠিক তাই।
কবে আসবো?
কাল। ঠিক সাড়ে এগারোটায়।
শেষে তাড়িয়ে দিবি না তো?
তোকে আমার বুকের গহীনে রাখবো।
তোর মা কি আমাকে পছন্দ করবে?
তোর মা-বাবা-ভাইয়েরা কী বলবে?
আমি কিচ্ছু তোয়াক্কা করি না।

বাসার ঠিকানা বলে দিয়ে খুব ব্যাকুলভাবে রাত পার করে শাহিদ।
সকালবেলা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলো সে। তার মনটা বেশ ফুরফুরে, কিন্তু দারুণ চঞ্চল। নাস্তা খেতে বসেই সে মায়ের কাছে কথাটা পাড়লো।
মা, আজ তোমাকে একটা মেয়ে দেখাবো।
প্রসন্ন কিন্তু আশ্চর্য চোখে মা তাকান। বলেন, কোন্ মেয়ে?
এটা একটা বিধবা মেয়ে। খুব গরীব। অসহায়। আমার ক্লাসমেট। ওর কষ্ট আমার আর ভাল্লাগে না। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
মায়ের মুখ কালো হয়ে যায়। বলেন, তুই খুশি হয়ে যা বিয়ে করে আনবি আমি তাকে নিয়েই খুশি।
শাহিদ হেসে দিয়ে বলে, এই তো তুমি আমার মায়ের মতো কথা বললে। কিন্তু আমি তোমাকে এতোখানি হতাশ করবো না। মেয়েটা দারুণ সুন্দরী। ওর বিয়ে হয়েছিল কানাডা প্রবাসী এক ছেলের সাথে। গতকাল নীলক্ষেতে আমার সাথে দেখা, আমাকে দেখেই সে পাগল। স্বামীর সংসারে সে সুখে নেই। আজ হোক কাল হোক এই স্বামীকে সে ডিভোর্স দিবেই। এখন আমি যদি এই মেয়েকে বিয়ে না করি সে পাগল হয়ে পাবনা যাবে। তুমি এতো মুখ কালো করছো কেন, এই মেয়ে তোমার চেয়ে তিনগুণ বেশি সুন্দরী।
ছেলের কথা শুনে মায়ের মাথা ঘুরে যায়।